চাপে ফেলে ভুতাপেক্ষ পদোন্নতিসহ সব সুবিধাই বাগিয়ে নিচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা

4
শেয়ার করতে ক্লিক করুন
রফিকুল ইসলাম সবুজ:
ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে দেশের সরকারি চাকরিজীবীদের কোন অংশগ্রহণ না থাকলেও পটপরিবর্তনের পর নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে সবচেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন তারা। আন্দোলনের নামে সরকারকে চাপে ফেলে ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি, চুক্তিভিত্তি নিয়োগ, ভাল পদায়নসহ সব সুযোগ সুবিধাই বাগিয়ে নিচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এমনকি দিনের ভোট আগের রাতে করার সাথে জড়িত রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারাও ভোলপাল্টে বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। ৫ মাসেও গণঅভ্যুত্থানে আহতদের তালিকা করে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলেও প্রশাসন ক্যাডারের পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের তালিকা খুব দ্রুত শেষ করে তাদের সুযোগ-সুবিধা ইতিমধ্যে সরকারের কাছ থেকে থেকে আদায় করে ফেলেছেন। বঞ্চিত সাবেক ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দের নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অথচ এখনো গতিশীল হয়নি প্রশাসন, আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারগুলো এখনো পায়নি পর্যাপ্ত সহায়তা। বিশ্লেষকরা বলছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো অন্তর্বর্তীকালিন সরকারও আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আমলাদের একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করছে সরকারকে। একারনে ভুয়া নির্বাচেনর মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখা দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করাতো দুরের কথা উল্টো বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের নামে সরকারকেই চাপের মুখে রেখেছেন আমলারা।
৫ আগস্টের পর থেকেই বিভিন্ন মহলের দাবি দাওয়ার আবদারে ব্যতিব্যস্ত অন্তর্র্বতী সরকার। তবে চাপে ফেলে সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নিতে সবচেয়ে এগিয়ে আমলারা। পট পরিবর্তনের পর দাবি আদায়ের মহোৎসব চলছে সচিবালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে। জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে গতি না ফিরলেও নির্ধারিত তিনমাসের আগেই বিগত সরকারের আমলে পদবঞ্চিতদের পুনর্মূল্যায়নে প্রতিবেদন দিয়ে দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যাচাই বাছাই কমিটি। ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতিসহ আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সুপারিশও করা হয়। আর সুপারিশের পর সময়ক্ষেপণ না করেই তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ৭৫ কোটি টাকা অর্থ ছাড়ের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তথ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা জানান, এই ৭৬৪ জন প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা চাকরিতে না থাকার পরও সম্মান ও আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। এই সুবিধা অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের দেওয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে ব্যাপক পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিভাগীয় মামলায় দোষী সাব্যস্ত কর্মকর্তারাও পদোন্নতি পেয়েছেন। সব সুবিধাই বাগিয়ে নিচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভোট জালিয়াতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল ডিসি, ইউএনওসহ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে চুক্তিতে থাকা ১০১ কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল করে নতুন ৬৫ জনকে চুক্তিতে নিয়োগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র ও ভূমি মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৪ মন্ত্রণালয়ে দুই বছর মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক সচিব ও সিনিয়র সচিব নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে পদবঞ্চিতদেরও। শীর্ষ পর্যায়ে কিছু পরিবর্তন ও পদোন্নতি দেওয়া হলেও কাজের গতি আসেনি, শৃংখলা ফেরেনি প্রশাসনে। প্রশাসন ক্যাডার ও বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে চরম বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে জনপ্রশাসন। সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার জুলাই ফাউন্ডেশনের অর্থ বরাদ্দেও গড়িমসি করার ঘটনা ঘটেছে। দুই মাস আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না বলে অভিযোগ ওঠেছিল। আহতরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ কয়েকজন উপদেষ্টার সামনে বিক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারায় সে সময় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব আকমল হোসেন আজাদকে এ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তুু  ৫ মাসেও আহতদের সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়নি। তালিকা চুড়ান্ত করা যায়নি আহত ও নিহতদের। এক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের অবহেলাকে দায়ি করছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন নাগরিক সেবা সহজ করা, কাজের গতি বাড়ানো ও দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে তেমন নজর না দিয়ে পদোন্নতি, পদায়নসহ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্দোলনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে কর্মকর্তাদের।
গণঅভ্যুত্থানে ভুমিকা না থাকলেও কর্মকর্তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের কারনে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কাজে গতি কমেছে এবং মানুষ সরকারি সেবা কম পাচ্ছে। অযাচিত কারণে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ঝুলে থাকছে। নানা জটিলতা তৈরি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকেও ধীর করে দেওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পড়ে থাকছে। বৈষম্য দূর ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে সরকার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করলেও তাদের প্রস্তাবিত সুপারিশের বিরুদ্ধে চাকরিবিধির তোয়াক্কা না করে আন্দোলনে নেমেছেন কর্মকর্তারা। বিধি ভেঙ্গে চলছে সভা, সমাবেশ ও কর্মবিরতির মতো কর্মসুচি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ দাবি করে কঠোর আন্দোলনেরও হুমকি দিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা। ঐ আন্দোলনে বিগত সরকার আমলের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারাও সামিল হয়েছেন। এতে অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও ঘটছে কালক্ষেপণ। এ নিয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের নীতিনির্ধারকরাও ক্ষুব্দ। তারা বলছেন বিগত আওয়ামী লীগ আমলে যেমন আমলাদের দাপট ও প্রাধান্য ছিল এখনো তাই আছে। শুধু শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন আমলা পরিবর্তন হলেও নতুন নিয়োগ পাওয়াদের একটি গ্রুপ নতুন সিন্ডিকেট তৈরি করে পুরো প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রন করছে। তারাও অন্তর্বর্তী সরকারকে জিম্মি করে ফেলেছে। অথচ গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল প্রশাসন ও অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট চুরিতে সরাসরি যুক্ত রিটার্নিং কর্মকর্তারা বর্তমানে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হয়ে ভোলপাল্টে নিজেদেরকে বঞ্চিতও দাবি করছেন।
সাবেক একাধিক সচিব ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকার পদে পদে দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। যারা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সভা সমাবেশ করছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অন্তবর্তীকালিন সরকারের আমলাতান্ত্রিকতার ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে গেছে। আহতদের তালিকা করতে ৫ মাস পরেও যাচাই-বাছাইয়ের গল্প শুনছি। কিন্তু পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের তালিকা খুব দ্রুত শেষ করে তারা তাদের সুযোগ-সুবিধা এই সরকারের কাছ থেকে আদায় করে ফেলেছে। এখন এই অসংগতিগুলো খুব জোরালোভাবে ঝুঁকে পড়ছে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫ ক্যাডার সরকারকে জিম্মি করে ফেলেছে। ফলে জনসেবা ও দাপ্তরিক কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি  রুটিন ও  জনস্বার্থের কাজগুলোও করতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে কাজের গতি অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারীরা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আইনগত সুযোগ নেই। আক্রমণাত্মক ভূমিকা সরকারি চাকরির আচরণ বিধিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এরপরও যদি আইন ও বিধি উপেক্ষা করে তারা আন্দোলন ও পালটাপাল্টি  কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকে তাহলে সরকারের উচিৎ হবে কঠোরহস্তে এসব বিশৃঙ্খলা দমন করা।
সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আসলেও জনপ্রশাসন তার কোন এ্যাকটিভিটিজ দেখাতে পারেনি। সাধারণ ছাত্র জনতার যে চাহিদা ছিল প্রশাসন সেই চাহিদাটা পূরন করতে পারছে না। বিগত স্বৈরাচারি সরকারের সময়ে তাদের সহযোগিতা করা কর্মকর্তাদের অনেকেই এখনো বহাল রয়েছে। তাদেরকে সরিয়ে নতুন লোককে কেন দায়িত্ব দেওয়া গেল না এটা একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে।
অন্তর্র্বতী সরকারের ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে জানিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমলাদের বক্তব্যে শুনতে পাচ্ছেন যে তাঁরা একধরনের হুমকি দিচ্ছেন। এটার সাহস পেয়েছেন বিগত সময়গুলোতে। তারা দেখেছেন, বিগত সরকার আমলে আমলাদের কীভাবে শক্তিশালী করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিজম তৈরি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, যাঁরা আন্দোলনের নামে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমলাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, জনগণকে সেবা দেওয়ার এখনই সময়। তাদের যে গণতান্ত্রিক ট্রানজিশনটা, সেটাকে সঠিকভাবে করতে সহায়তা করা। আন্দোলন-আন্দোলন খেলা কিংবা তাঁদের গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষার জন্য কিন্তু এতো মানুষ জীবন দেয়নি। সুত্র: সময়ের আলো।
শেয়ার করতে ক্লিক করুন