ড. ইউনুস এর বিরুদ্ধে এক মামলার আপীলে বেসরকারি আইনজীবীকে ৮ লাখ টাকা ফি

52
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

রফিকুল ইসলাম সবুজ :
গত ৭ বছরে হয়রানিমুলক ২৬৬ টি মামলা দায়ের করানো হয়েছে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে গ্রামীন টেলিকমের শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় শ্রম আদালতের দেওয়া ছয় মাসের কারাদণ্ডের রায় গত ৭ আগষ্ট বাতিল করেছেন শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রনালয়ের সাবেক এক সচিব এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ মদদ ও নীলনকশায় ড. ইউনুস এর বিরুদ্ধে শ্রম আইনে গণ হারে হয়রানিমুলক মামলা হলেও এসব কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

অন্যদিকে এটর্নী জেনারেল অফিসে সরকারি খরচে আপিল ও লিভ-পরিচালনা করার সুযোগ থাকলেও তা না করে আইন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি ছাড়াই তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, সচিব এহছানে এলাহী এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার পরামর্শে সরকার বেআইনীভাবে মামলা পরিচালনার জন্য ২৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেছে। শুধুমাত্র একটি মামলার আপীল এর জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খানকে ৮ লাখ টাকায় বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।

মন্ত্রনালয় সুত্র জানায়, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে ২০১৭ সালে গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীরা ৫১টি, ২০১৮ সালে ৪১টি, ২০১৯ সালে ২টি, ২০২০ সালে ১৭টি, ২০২১ সালে ৩১টি, ২০২২ সালে ১২টি এবং ২০২৩ সালে ৩১টি মামলা করেন। এছাড়া ২০১৯ সালে গ্রামীণ কমিউনিকেশনের কর্মচারীরা ৭টি, ২০১৯ সালে গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের কর্মচারীরা ১টি এবং ২০২৩ সালে গ্রামীণ কল্যাণের কর্মচারীরা ৬৯টি মামলা করেন। সব মিলিয়ে ড. ইউনুস এর বিরুদ্ধে মোট ২৬২ টি মামলা দায়ের করানো হয়। তবে গ্রামীণ কল্যাণের ১০৬ জন শ্রমিক কর্মচারীর মামলা সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে স্থিতিবস্থা বিরাজমান অবস্থায় আছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর বিরুদ্ধে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়াধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক দায়ের করা মামলার মধ্যে ২০১৯ সালে গাজীপুর কার্যালায়ের উপমহাপরিদর্শক মো: ইউসুফ আলী, শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) শোভন দাস ও উজ্জল দেব, ঢাকা কার্যালায়ের উপমহাপরিদর্শক আহম্মেদ বেলাল,  শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) মোঃ তৌফিকুল ইসলাম ও মোঃ তরিকুল ইসলাম মামলার বাদী হন। এছাড়া  ২০২০ সালে মামলার বাদী ছিলেন ঢাকা কার্যালায়ের উপমহাপরিদর্শক একেএম সালাহউদ্দিন, শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) মোঃ নুরুল আমিন এবং ২০২১ সালে ঢাকা কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক এস এম আরিফুজ্জামান।

সংস্লিষ্টার অভিযোগ করেন যুগ্মমহাপরিদর্শক পদে মো: বুলবুল আহমেদ প্রধান কার্যালয়ে যোগদানের পর থেকে তৎকালীণ প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান ও তাঁর আত্মীয়দের দুর্নীতি এবং ড. ইউনুসের মামলা পরিচালনার প্রধান পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছেন। মন্নুজান, মন্নুজানের এপিএস ভাই শাহাবুদ্দিন, শাহাবুদ্দিনের মেয়ে শামীমা সুলতানা হৃদয়ের তত্ত্বাবধানে এবং তাদের পরামর্শে শ্রম আদালতে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হতো সরকারকে খুশি করার জন্য। বিএলএ (ফৌজদারী) মামলা দায়েরের (মামলা নং-২২৮/২০২১) পর হাইকোর্ট ডিভিশনে ড. মুহাম্মদ ইউনুস স্থগিতাদেশ পাওয়ার পর সরকার পক্ষে স্থাগিতাদেশ খারিজ করার জন্য ক্রিমিনাল লিভ পিটিশন দায়ের করা হয়। অতীতে কলকারখানা অধিদপ্তর এ ধরণের কোন স্থগিতাদেশ  এর বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে যায়নি বলে সংস্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

অন্যদিকে অফিসে সরকারি খরচে আপিল, লিভ-পরিচালনা করার সুযোগ থাকলেও তা না করে আইন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি ছাড়াই তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী, সচিব, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ও যুগ্মমহাপরিদর্শক এর পরামর্শে সরকার বেআইনীভাবে বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগ করে ২৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেছে বলে অভিযোগ করেছেন মন্ত্রনালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। তারা জানান, ডঃ ইউনুসের মামলা পরিচালনা এবং আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছতার প্রস্তাব করায় কলকারখানা অধিদপ্তরের আইন কর্মকর্তাকে ডঃ ইউনুসের লোক হিসেবে ট্যাগ লাগিয়ে প্রথমে নরসিংদী এবং তার দুই দিন পর রংপুরে বদলী করা হয়। শ্রম অধিদপ্তরের একজন পরিচালক ও কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের একজন যুগ্ম মহাপরিদর্শক এই বদলীর বিষয়ে ভূমিকা রাখেন। মামলাটি আদালতে চলার মত উপাদান না থাকলেও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিভিন্ন পর্যায়ে অতিউৎসাহী হয়ে মামলার রায় পক্ষে আনার জন্য কাজ করেন। তাদের পরামর্শে ড. ইউনুস এর বিরুদ্ধে শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালে চলমান একটি আপীল মামলা পরিচালনার জন্য কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. আবদুর রহিম খান গত ২৮ জানুয়ারি এ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খানকে ৮ লাখ টাকায় বেসরকারী আইনজীবি হিসেবে নিয়োগ করেন। এই কর্মকর্তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব-২ গাজী হাফিজুর রহমানকে নিয়মিত ড. ইউনুস এর মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে অতিউৎসাহী হয়ে পরামর্শ দিতেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের কয়েক জন কর্মকর্তা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রীর আনুগত্য, পদোন্নতি, ভালো পোস্টিং ও দুর্নীতির জন্যই নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে বিতর্কিত মামলা দায়ের করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করেন। একাজে সার্বিক সহায়তা করতেন উপমহাপরিদর্শক আহমেদ বেলাল, একেএম সালাউদ্দিন, আব্দুল মুমিন, মো: আকিদ-উল-হাসান এবং শ্রম পরিদর্শক মো: তরিকুল ইসলাম, মো: নুরুল আমিন, মোঃ তৌফিকুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, সবুজ শেখ, মীর মোহাম্মদ শামীম ও শাহ আলম; মো: আতাউর রহমান, শ্রম অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক  শাহীনুর ইসলাম এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আসাদুজ্জামান মোড়ল ও মো: সাইফুল ইসলাম।

এ বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্মমহাপরিদর্শক (প্রশাসন) বুলবুল আহমেদ বলেন, তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কারণ মামলা করে অধিদপ্তরের ঢাকা অফিস। আর মামলা করার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হতো। প্রধান কার্যালয়ে তিনি শুধুমাত্র প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ড. ইউনুস সাহেব এর বিরুদ্ধে যখন মামলা হয় তখন তার পোষ্টিং ছিল ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ ও সিরাজগঞ্জে। প্রধান কার্যালয়ে তিনি যোগ দিয়েছেন ২০২২ সালের জুলাই মাসে। একটি গ্রুপ তার এই পদে পোষ্টিং নেওয়ার জন্য মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করেছে।

এবিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের সাবেক সচিব এহছানে এলাহী বলেন, তার বিরুদ্ধে কোন মহল মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। বরং তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনুস সাহেব এর মামলার বিরুদ্ধে থাকায় তাকে সচিব পদে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চুক্তি বাতিল করে বের করে দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের অভিযোগ ছিল যে যাদেরকে বদলী করা হয়েছিল তিনি নাকি তাদেরকে কাছে টেনে এনেছেন। তিনি নাকি নেগেটিভ ছিলেন। একারনে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সচিব পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।
##

 

 

শেয়ার করতে ক্লিক করুন