মো. শফিকুল ইসলাম: দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়ছে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান সবুজ সংকেত দিয়েছেন। এমনকি জামায়াতের বিষয়ে নিজের অভিমত লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানকেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। এখন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাদের আর কোন বাধা নেই। স্থায়ী কমিটির সদস্যরাই ঠিক করবেন আগামী দিনে জামায়াত জোটে থাকবে কি না। যেখানে থাকছে না চেয়ারপারসনের আপত্তি। এছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে অনেক আগে থেকেই তৃণমূলের চাপে রয়েছে। তাই দলের দুই প্রধানের সবুজ সংকেত পাওয়ায় জামায়াতকে ছেড়ে দিবে দলটি। চলতি বছরেই জামায়াতের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, জামায়াত ইস্যুতে বেগম খালেদা জিয়া আগের অবস্থান থেকে অনেক সরে এসেছেন। বাস্তবতা বুঝতে পারছেন এখন তিনি। বিএনপি ক্লিন ইমেজের ধারায় ফিরে আসুক চাইছেন তিনি। তাই স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মতামতে তিনি ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত ছাড়ার ঘোষণা দেওয়া হবে। জামায়াতের পক্ষ নিয়ে বিরোধীতা করলে তা ধোপে টিকবে না।
বিএনপির বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনলাইনে ধারাবাহিকভাবে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে দলের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। সেখানে দলটির প্রায় প্রত্যেক সদস্যই ‘যুদ্ধাপরাধী’ সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের কথা বলেন। তাদের যুক্তি তুলে ধরেন। জামায়াতের কারণে বিএনপি অতীতে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। জোটবদ্ধ থাকলে আগামী দিনে বিএনপির রাজনীতি আরো হুমকিতে পড়বে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। এছাড়াও বিএনপির মধ্যম সারি, তৃণমূলের নেতারা ও তরুণ নেতারা শুরু থেকেই জামায়াতকে জোটবদ্ধ করার বিরোধিতা করে আসছেন বলেন জানান।
এরপর স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জামায়াত বিষয়ে হওয়া আলোচনার বিষয়বস্তু খালেদা জিয়ার কাছে পাঠিয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া বর্তমানে শর্তসাপেক্ষে মুক্তিতে রাজনীতির বাইরে রয়েছেন। তাই পারিবারিক পন্থায় বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের এক নেতা তার সঙ্গে দেখা করে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের বিষয়ে মতামত জানতে চান।
সুত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির বেঠকের মতামত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘নো সে’। আমার কিছু বলার নেই। দলের স্থায়ী কমিটিতে যদি জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার মতামত এসে থাকে, তাহলে যা ভালো মনে করেন, করতে পারেন!’ তিনি সাফ জানিয়ে দেন, জামায়াত বিষয়ে নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্তেই তার আপত্তি নেই।
দলের একাধিক নেতা বলছেন, জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করবে কিনা, দীর্ঘদিন এনিয়ে দলের ভেতরে চলছে আলোচনা। সবাই জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার মত দিলেও বিষয়টি নির্ভর করছিল বেগম খালেদা জিয়ার ওপর। কারণ তার একক সিদ্ধান্তেই গড়ে ওঠে বিএনপি জামায়াত সম্পর্ক। তবে জামায়াত ছাড়া, না ছাড়ার বিষয়ে এতদিন স্পষ্ট করে কিছু না বললেও এবার খালেদা জিয়া নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। ফলে বিএনপি এবার জামায়াতের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ বিষয়ে আর কোনো বাঁধা রইল না।
নাম প্রকাশে অচ্ছিুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে এর কারণ, অনেক দিনের সম্পর্ক হুট করে শেষ করা যায় না। তবে এ বছর জামায়াতকে ছাড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। এতদিন খালেদা জিয়ার মতামত নেওয়াই ছিল বড় বিষয়। তার সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ এবং সময় কম লাগবে।
তিনি আরো বলেন, তবে মনে রাখতে হবে, জামায়াতসঙ্গ ছাড়ার বিষয়ে বিএনপির ওপর যারা বেশি চাপ দিচ্ছেন। এখন তাদের চাপে যদি আমরা জামায়াতকে ছেড়ে দেই, ভবিষ্যৎতে তারা অন্য কোনো বিষয় বা ব্যক্তিকে নিয়ে আমাদের চাপ দেবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? ফলে সবদিক বিবেচনা করেই আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগের চাপ রয়েছে দলটি। এরই অংশ হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে বছরব্যাপী কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না জামায়াতকে। অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ মহাজোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোটের শরিকসহ বিকল্পধারাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যজোট’ গঠনের উদ্যোগের অংশ হিসেবে জামায়াতকে ত্যাগ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। জোট গঠনের খসড়া রূপরেখাও তৈরির কাজ চলছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলছেন, দলের নীতি নির্ধারণী ফোরামে বিষয়টি আলোচনায় আসে গত বছরের শেষ দিকে। মাঝে সেই আলোচনায় কিছুদিন বিরতি ছিল এবং এখন আবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় তাদের স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই জামায়াতের সাথে তাদের দলের জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করার পক্ষে মত দিয়েছেন। শুধু দুইজন সদস্য মত দিয়েছেন জামায়াতের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখার পক্ষে। আর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখনো সিধান্ত দেয়নি। স্থায়ী কমিটি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিষয়টিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া।
দলের নতুন প্রজন্মের নেতারা বলছেন, দলের এই দুরবস্থার জন্য অনেকাংশে জামায়াতই দায়ী। দেশ-বিদেশে বিএনপির ক্লিন ইমেজ সংকটের মূল কারণ জামায়াত। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকা জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতার কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বিএনপির সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলোও বিএনপিকে ভালো চোখে দেখছে না। তাই যত দ্রুত জামায়াতকে ছাড়তে পারবে ততই বিএনপির জন্য মঙ্গল বলে মনে করেন তারা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের এখনই উপযুক্ত সময়। দুটি বিষয়কে সামনে রেখে এটি আমরা সহজভাবে করতে পারি। প্রথমটি হলো- জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা নিয়ে বিএনপির ওপর দীর্ঘদিনের দেশি ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো- এতদিন ধর্মীয় রাজনীতি ও ইসলামী ভোট জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে, এই যুক্তিতে তাদের জোটে রাখা হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে চিত্র বদলে গেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ভোট এখন অনেকাংশে হেফাজতে ইসলামের দখলে। এছাড়া বর্তমানে ধর্মীয় রাজনীতিতে জামায়াতের চেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে ইসলামী ঐক্যজোটসহ অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলোর। ফলে কূটনৈতিক ও দেশীয় রাজনৈতিক ভোটের হিসাবের বিবেচনায় জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের বিএনপির সময় এখনই।
এ বিষয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমাদের সঙ্গে জোটের শরিকদের সাথে ভালো সম্পর্ক। এখনো ২০ দলীয় জোটে আছি। গত মাসে জোটের দুটি বৈঠক হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি থেকে এ বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কথা বলেনি। কিছু ঘটলে আপনারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারবেন।
এবিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেন, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোট রাজনৈতিক ও ভোটের। তাদের সঙ্গে আদর্শিক কোনো জোট নয়। তবে বিএনপির জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। সময় হলে সবকিছু জানতে পারবেন।
জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জামায়াতের ইস্যুসহ সব জোট নিয়েই বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ে পুনর্মূল্যায়ন চলছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দলের হাইকমান্ড জামায়াতকে জোটে রাখা না রাখার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। জামায়াতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে অবশ্যই আলাপ আলোচনা চলছে। আমাদের ২০ দলীয় জোট এখনও অক্ষুণ আছে। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন কোনো মতামত দিয়েছেন কিনা, জানতে চাইলে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।