সম্ভাবনাময় সুন্দরবনে গড়ে ওঠেনি টেকসই অবকাঠামো
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। ম্যাগ্রোভ সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলা হয়। ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রা হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলও সুন্দরবন। এছাড়া দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। বিভিন্ন সময়ে সুপার সাইক্লোন নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করেছে মায়ের মত।
তবে উপকূলের কোটি-কোটি মানুষকে নিরাপদে রাখলেও সুন্দরবন এখন নিজেই ভালো নেই। জলবায়ু পরিবর্তন,পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, বন্যপ্রাণী শিকারি ও কাঠ পাচারকারীদের কারণে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবন। এদিকে বনবিভাগ বলছে, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্যাট্রোলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বনের মধ্যে আঁকা-বাঁকা নদী, খাল ও তিন নদীর মোহনা রয়েছে সতেরশো বর্গকিলোমিটার। দেশের সমগ্র সংরক্ষিত বনভূমির অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৫১ শতাংশ বনই হচ্ছে সুন্দরবন। প্রায় ৬ হাজার ১১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ বনে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা।
রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। নদ-নদীতে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় তালিকায় থাকা ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন ও ২১০ প্রজাতির মাছ। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিষয়ে বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। ১৯৮২ সালের জরিপে দেখা যায় বাঘের সংখ্যা ৪২৫টি। ১৯৮৪ সালে সুন্দরবনের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়।
২০১৮ সালে করা একটি জরিপের ফলাফলে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১১৪টি। ২০১৫ সালে ‘ক্যামেরা ট্র্যাকিং’ পদ্ধতিতে পরিচালিত জরিপে বাঘের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০৬টি। ২০০৪ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী ৪৪০টি বাঘের মধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় ৮৯টি পুরুষ, ১৭০টি স্ত্রী এবং ১২টি বাঘ শাবক, বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় ৩২টি পুরুষ, ১২৮টি স্ত্রী এবং ৯টি বাঘ শাবকের অবস্থান জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল। অর্থাৎ দেড় যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩২৬টি বাঘ কমেছে সুন্দরবনে। আর কয়েক বছরে বেড়েছে মাত্র ৮টি বাঘ। তবে বর্তমানে সুন্দরবনের বাঘের আনাগোনা বাড়ছে।
সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বাঘের অবাধ বিচরণ ও প্রতিনিয়ত বাঘের শাবকের দেখা মিলছে বলে জানান সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালিরা। হরিণ শিকারের বিষয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবনে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হরিণ শিকারিরা। তারা বনের মধ্যে ফাঁদ পেতে ও গুলি করে চিত্রা ও মায়া হরিণ শিকার করছে।
সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের গহীনে হরিণ বিচরণের স্থান সমূহে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। কখনো তারা গুলি ছুড়েও শিকার করে। পরে গোপন আস্তানায় মাংস তৈরি করে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে। সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা, শরণখেলা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছাসহ বনের আশপাশ এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। এভাবে হরিণ শিকার করে বিক্রি করতে গিয়ে অনেকে ধরাও পড়েন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে।
সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি মোংলা উপজেলার ডাংমারি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪২ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন, মোংলার সদস্যরা। অপরদিকে সুন্দরবনের আশপাশের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করতে না পারায় সুন্দরবনের মৎস্য খ্যাত ভাণ্ডার নদী-খাল ক্রমশ-ই মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে। বিষ দেওয়ার ফলে শুধু মাছ-ই নয় মারা যাচ্ছে অন্যান্য জলজ প্রাণীও।
এতে একদিকে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বনজ সম্পদসহ পরিবেশের ওপর অন্যদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে বাগেরহাটের উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের। এই অবস্থায় জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান বনের সাথে সংশ্লিষ্টরা। তবে সুন্দরবন জুড়ে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান অব্যহত রয়েছে। কিন্তু এতেও দৌরাত্ম্য কমছে না অসাধু জেলে-ব্যবসায়ীদের।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, সুন্দরবনের সৌন্দর্য হলো বন্যপ্রাণী। সেই বন্যপ্রাণী যারা নিধন করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের দাবী জানিয়ে আসছি। কিন্তু কঠোর আইন না থাকায় প্রচলিত আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে তারা পুনরায় সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী নিধনে লিপ্ত হয়।
তিনি আরো বলেন, বাঘ ও সুন্দরবনের বন্য প্রাণী রক্ষায় সরকার সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ বনভূমিকে অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের যে শর্ত, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে বাঘের প্রজনন বাড়বে। প্রজনন বাড়লে বাঘও বাড়বে।
সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় একশ্রেণির জেলে নৌকা ও ট্রলার নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এতে শুধু মাছ নয়, পানি বিষাক্ত হয়ে অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাঘসহ বন্য প্রাণী রক্ষায় সাধারণ মানুষকেও সোচ্চার হতে হবে। বন্য প্রাণী হত্যা, ক্রয়-বিক্রয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে বলে জানান তিনি।
বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে খাদ্যচক্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে বলে জানান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের প্রভাষক রাবেয়া সুলতানা। তিনি বলেন, এসব কীটনাশক যেখানে প্রয়োগ করা হয়, সেখানে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা যায়। মাছের পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদও (মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য কণিকা) মারা যাচ্ছে। ফলে খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক খাদ্য চক্রের উপরে। কিন্তু যদি প্রাকৃতিক উপায়ে মাছ ধরা হয় তাহলে খাদ্য চক্রের উপরে খুব বেশি প্রভাব পড়ে না বলে জানান তিনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি পানি ও মাটির লবণাক্তটা বৃদ্ধি। এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম লবণসহিষ্ণু সুন্দরী, পশুর, গোলপাতা ও খলিসা গাছের সংখ্যা কমছে। অন্যদিকে বেশি লবণসহিষ্ণু গরান, গেওয়া, কেওড়া, বাইন গাছ, কালিয়ালতা, গিলালতাসহ লতাগুল্ম বাড়ছে। এ অবস্থায় সুন্দরবনের পুরোনো জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন ঘটছে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোসায়েদ হোসাইন বলেন, সুন্দরবনে যে কোনো অপরাধ দমনে কোস্টগার্ড সদা প্রস্তুত থাকে। বন বিভাগকে আমরা সব ধরনের সহযোগীতা করে থাকি। এছাড়া সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে আমরা বনায়ন করেছি। প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় বনের সাথে জড়িত সকলকে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
র্যাব-৬ খুলনার অধিনায়ক (সিইও) লেঃ কর্নেল মুহাম্মদ মোসতাক আহমদ বলেন, দস্যুমুক্ত সুন্দরবন গড়তে র্যাবের ভূমিকা ছিল অনন্য। এছাড়া বন্য প্রাণী রক্ষা ও পাচার প্রতিরোধ করতে র্যাব বদ্ধপরিকর। বন্যপ্রাণী রক্ষা ও অপরাধ দমনে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও লোকালয়ের যেখানেই বন্যপ্রাণীর খবর পাওয়া যায় আমরা সেখান থেকে উদ্ধার করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
এবিষয়ে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, সুন্দরবন সুরক্ষা করতে বন সংলগ্ন এলাকার মানুষদের আমরা বিভিন্ন ভাবে সচেতন করছি। যাতে সুন্দরবনের উপরে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে। এছাড়া বনের মধ্যে যে কোনো অপরাধ আমরা কঠোর ভাবে দমন করি।
ডিএফও আরও বলেন,বন্যপ্রাণীর প্রজনন,বংশবৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঘ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। চোরাশিকারিদের তৎপরতা বন্ধে স্মার্ট পেট্রোলিং চালু রয়েছে।