অর্থ সংকটে বিমান: ঝুঁকছে বিকল্প ব্যবসায়

1315
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

এসএম শামসুজ্জোহা: করোনা মহামারিতে কাঙিক্ষত আয় না হওয়ায় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বড় ধরনের অর্থ সংকটে পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, টাকার অভাবে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও নাকি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এভিয়েশন খাত সীমিত আকারে ফ্লাইট শুরু হলেও পরিচালন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিমান এয়ারলাইন। উপরন্তু নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিমানের লোকসান ক্রমেই বাড়ছে। অন্যদিকে, ক্ষুন্ন হচ্ছে সংস্থাটির ভাবমূর্তি। অর্থ সংকটের মুখে বিমান বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে নিজস্ব প্রেস, মোটর ট্রান্সপোর্ট, পোল্টি ফার্মকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিমানের অপারেশনাল ব্যয় কমিয়ে আয় বৃদ্ধির চেষ্টা বিমানকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহায়তা করবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ বিমান সূত্র জানায়, বিমানের ফ্লাইট পরিচালনার সক্ষমতা থাকলেও অর্থ সংকটের কারণে সব রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারছে না বিমান। বরং ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় যাত্রীদের টাকা ফেরত দিতে হয়েছে। দেশে ও বিদেশে বিমানের অফিস পরিচালনা ব্যয় শত কোটি টাকার ওপরে। বিমানের বহরের রয়েছে, ১৯টি উড়োজাহাজ, যেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে মাসে প্রায় ২৬০ কোটি টাকা খরচ হয়। বিমানে নয় মাসে লোকসান আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে করোনা মহামারিতে ব্যয় কমাতে কর্মীদের বেতন কাটা শুরু করে বিমান, যা এখনও চলমান রয়েছে। তবে তাতেও সুবিধা করতে না পেরে সরকারের কাছ থেকে এক হাজার কোটি টাকা লোন নিয়েছে সংস্থাটি।

বিমান কর্মকর্তারা বলছেন, বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে বিমানের নিজস্ব ছাপাখানা, গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ এবং মাছ, মুরগি, গরু, সবজি চাষের খামার রয়েছে। বিমানের নিজস্ব প্রয়োজনে মেটানো হয় এসব জায়গা থেকে। তবে এ খাতগুলো বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে আয়ের উদ্যোগ নিয়েছে বিমান। নতুন ভাবে রুটও চালু করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। আগামী মার্চ মাসে টরন্টো, টোকিও ও চেন্নাই রুটে বিমানের নিজস্ব এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট শুরু হবে। ঢাকা-নিউ ইয়র্ক সরাসরি ফ্লাইটের ব্যাপারে উদ্যোগ চলমান রয়েছে।

জানা গেছে, রাজধানীর ফার্মগেটে বিমানের নিজস্ব জায়গায় মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগ রয়েছে। একজন মহা ব্যবস্থাপকের অধীনে এই ছাপাখানায় এত দিন বিমানের বোর্ডিং কার্ড, ম্যানুয়াল, মানি রিসিট, ফরমসহ প্রয়োজনীয় মুদ্রণের কাজ করা হতো। তবে ছাপা টিকিটের ব্যবহার না হওয়া ও অনলাইনের ব্যবহার বাড়তে থাকায় ছাপার পরিমাণ কমতে থাকে। সম্প্রতি আয় বাড়াতে ছাপা খানায় আধুনিকায়ন করা হয়েছে। নতুন করে জনবল প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। বর্তমানে এ ছাপাখানায় রয়েছে জার্মানির হাইডেলবার্গ কোম্পানির প্রিন্টিং মেশিন, পোলার পেপার কাটিং মেশিন, প্লেট মেকিং মেশিন, ডাই কাটিং মেশিন, গন্টু/ম্যাট/স্পট লেমিনেশন মেশিন, প্যানা-পিভিসি প্রিন্টিং মেশিন। ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলোর বিভিন্ন প্রকাশনা বিমানের নিজস্ব প্রেসে মুদ্রণের কাজ শুরু হয়েছে।

সাভারের গণকবাড়ী এলাকায় ৭৬ দশমিক ১২ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে বিমানের নিজস্ব পোলট্রি কমপ্লেক্স। সরকারের কাছ থেকে এডিপির লোন নিয়ে ১৯৭৬ সালে বিমান এই কমপ্লেক্স স্থাপন করে। এখান থেকে ১৯৮০ সালের ১০ নভেম্বর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করা হয়। সেখানে রয়েছে ব্রয়লার ইউনিট, ফিড মিল ইউনিট, ডেইরি ইউনিট, ফিশারিজ ইউনিট, এগ্রিকালচার ইউনিট। বিমানের ফ্লাইটে যাত্রীদের খাবারের জন্য এই ফার্ম থেকে উৎপাদিত মাছ, মাংস, সবজি সরবরাহ করা হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য সীমিত আকারে এতদিন বিমান পোলট্রি কমপ্লেক্সের বিক্রয় কেন্দ্র ও হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা বিমানের এমটি গেট সংলগ্ন বিমান পোলট্রি কমপ্লেক্সের বিক্রয় কেন্দ্র বিক্রি করা হতো। সেখানে পাওয়া যায়- ড্রেসড্ মুরগি, মুরগির গিলা-কলিজা, মুরগির লেফ্টওভার, ডিম, গরুর দুধ, গরুর মাংস, তেলাপিয়া মাছ, নাইলোটিকা মাছ, পাঙ্গাস মাছ, মৌসুমি শাক-সবজি ও ফলমূল। এসব পণ্য এখন রাজধানীর বিভিন্ন বাজারসহ বিমানের অন্যান্য সেলস সেন্টারে প্রতিনিয়ত ব্যাপক হারে বিক্রির জন্য প্রর্দশন করা হবে।

হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় রয়েছে বিমানের নিজস্ব মটর ট্রান্সপোর্ট ইউনিট। সেখানে বিমানের কর্মী, যাত্রী, পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত যানবাহন মেরামতের কাজ করা হয়। বিমানের নিজস্ব জনবল দিয়ে পরিচালিত এ ইউনিটটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিমানের নিজস্ব পরিবহন ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গাড়ি মেরামত করে আয় করতে এ উদ্যোগ নিয়েছে বিমান।

এসব বিষয়ে বিমান অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব মফিজুর রহমান দিন পরিবর্তনকে বলেন, সরকারকে অ্যারোনটিক্যাল ও নন অ্যারোনটিক্যাল চার্জ মওকুফের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে আশ্বাস পাওয়া গেছে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিমানের জ্বালানি সহনীয় দামে পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারে বিমানা। এ ক্ষেত্রে তাদের ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ দেবে সরকার।

তিনি আরো বলেন, বিমান এয়ারলাইন্সগুলো প্রাণপণে টিকে থাকার চেষ্টা করবে কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। ইতোমধ্যে এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসেসিয়েশনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সরকারের কাছে জেট ফুয়েলের দাম সমন্বয় করা, যন্ত্রাংশের ট্যাক্স মওকুফ, ল্যান্ডিং, পার্কিং, নেভিগেশন চার্জ মওকুফসহ সরকারের নীতি সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোকাব্বির হোসেন বৃহস্পতিবার মোবাইলে বলেন, করোনার কারণে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে এ খাত। বর্তমান এভিয়েশন গোটা সেক্টরে টাকার প্রয়োজন। এয়ারলাইনসের কাছ থেকে পাওনা টাকা সময়মতো আদায় করা গেলে আরো কিছু জরুরি প্রকল্পের কাজ শুরু করা যেত। এই মুহূর্তে একটি হেলিপোর্ট নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে ইতোমধ্যে বিমানের কর্মীদের বেতন ১০ শতাংশ এবং ভাতা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে। ক্ষতি কমাতে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো বড় ঘোষণা আসতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, পুরো পৃথিবীতেই করোনা মহামারির কারণে এভিয়েশন ও পর্যটন খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনও সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বর্তমানে বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ফ্লাইট চলাচল করলেও মুনাফা অর্জন সহজ নয়। রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স বিমানও এ সংকটের মুখোমুখি।

লোকসান কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া প্রসঙ্গে মাহবুব আলী বলেন, বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিমানের প্রেস, মোটর ট্রান্সপোর্ট, পোল্টি ফার্মকেও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিমানের অপারেশনাল ব্যয় কমিয়ে আয় বৃদ্ধির চেষ্টা বিমানকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহায়তা করবে।

উল্লেখ্য, বিমানের বহরে মোট ১৯টি প্লেন রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি নিজস্ব ও ৬টি লিজে আনা হয়েছে।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন