নিজস্ব প্রতিবেদক:
সম্প্রতি নায়িকা পরিমনি ও মডেল পিয়াসা কেলেঙ্কারির ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন বেসরকারি ব্যাংকের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। গতকাল শনিবার সিআইডি কার্যালয়ে বেসরকারি ব্যাংকের ঐ এমডিকে দীর্ঘসময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাকে নজরদারিতে রেখেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একই সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে নাম বেরিয়ে আসা সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা তৈরি করেছে সিআইডি। তালিকায় নাম থাকা সবার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তদন্তের অংশ হিসেবে এসব পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছে সিআইডি।
সংস্লিষ্ট সুত্র জানায়, মডেল পিয়াসার সঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড উদ্ধার হয়েছে। এছাড়াও একটি বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের সঙ্গে মডেল মরিয়ম আক্তার মৌয়ের গোপন ভিডিও রয়েছে। পিয়াসার সঙ্গে একজন অলংকার ব্যবসায়ীর বেশ কয়েকটি অডিও রেকর্ড পেয়েছে সিআইডি।
একটি অডিও রেকর্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে পরীমণির অডিও রেকর্ডে একটি গাড়ি উপহার দেওয়ার কথা রয়েছে। একই সঙ্গে ঐ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরীমণির গভীর সখ্যের বিষয়টি কথোপকথনে উঠে এসেছে। এই ব্যাংকের এমডির বিরুদ্ধে এর আগে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের বিষয়ে এ প্রতিবেদক বেসরকারি ব্যাংকের ঐ এমডির বক্তব্য জানার জন্য রোববার দুপুরে তার মোবাইল ফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে এসএমএস এর মাধ্যমে বক্তব্য জানতে চাইলেও কোন উত্তর দেননি।
এদিকে, নায়িকা পরীমনি, মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ, বহিষ্কৃত নেত্রী ও ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর, মিশু হাসান এবং প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজের বাসায় একযোগে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে সিআইডি। মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে শনিবার এই অভিযান চালানো হয়।
সিআইডির অভিযানসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, অভিযানে পরীমনির বাসা থেকে দুটি ল্যাপটপ, চারটি মোবাইল ফোন, পেনড্রাইভ, মেমোরি কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের জন্য এসব সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিআইডি।
নায়িকা, মডেল, প্রযোজক এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, মাদকব্যবসাসহ নানা অভিযোগে দায়ের হওয়া ৭টি মামলার তদন্তভার শুক্রবার সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। এর পর তদন্তে মাঠে নামে সিআইডির তদন্ত টিম। এর মধ্যে পরীমনি ও রাজের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুটি মামলা সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়।
সূত্র জানায়, আসামিদের হাতে পাওয়ার পরই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম বেরিয়ে আসে। এর পরই তদন্তের অংশ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। তদন্তে নেমে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিলছে তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই তালিকার সূত্র ধরে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে সিআইডি। এরই অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এমডিদের নজরদারি এবং দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সিআইডি। দেশের সবগুলো ইমিগ্রেশনকে তাদের বিষয়টি জানানো হয়। তবে তদন্তের স্বার্থে এসব ব্যাংকের এমডিদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগগুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু জানাতে চায়নি সিআইডি। সিআইডি বলছে, কৌশলগত কারণে তারা এখনই বিস্তারিত জানাতে চান না। ইতোমধ্যে এসব মামলা তদন্তে তদারক, জিজ্ঞাসাবাদ এবং অভিযান পরিচালনার জন্য পৃথক টিম গঠন করেছে সিআইডি। সিআইডির শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা বলেন, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যতই প্রভাবশালী হোক, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এদিকে, মামলা নিজেদের হাতে বুঝে পাওয়ার পর গতকাল দুপুরে মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে সংস্থাটির অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, শুক্রবার নায়িকা পরীমনি, ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌয়ের সাতটি মামলা আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আসামিদের আমরা পেয়েছি। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আমরা তদন্ত শুরু করেছি, তদন্তপরবর্তী যে কোনো বিষয়ে আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব। আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন, আইনের মধ্যে থেকেই মামলা তদন্ত করবে সিআইডি, সুষ্ঠুভাবে তদন্তকাজ সম্পন্ন হবে। তিনি আরও বলেন, এসব ঘটনার পেছনে যারা জড়িত আমরা তদন্তের মাধ্যমে তাদের খুঁজে বের করব, তারা যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন।
মামলার তদন্তে কোনো তদন্ত-তদারক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে এ বিষয়ে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সে তদন্তকারী কর্মকর্তা হোক বা যে কেউ হোক। আমরা চাই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন করতে।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদের সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তালিকায় আরও নাম যুক্ত হবে বলে মনে করছেন সিআইডি কর্মকর্তারা। তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ ছাড়া এসব ব্যক্তিরা অবৈধভাবে আয় করা অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন কিনা, সে বিষয়টিও তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তার তালিকায় আরও বেশ কয়েকজনের নাম রয়েছে। এদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিও রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা শুরু করেছি।
গত ৩ আগস্ট রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান এবং তার সহযোগী মো. মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা রাজধানীর অভিজাত এলাকার গুলশান, বারিধারা ও বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টি আয়োজনের বেশ কয়েকটি স্থানের তথ্য প্রদান করে। এই তথ্যের ভিত্তিতে গত বুধবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত বনানী এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে শামসুর নাহার স্মৃতি ওরফে স্মৃতিমনি ওরফে পরীমনি, মো. নজরুল ইসলাম ওরফে রাজ, পরীমনির ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম দীপু ও রাজের ম্যানেজার সবুজ আলীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গত ২ আগস্ট রাত ১০টার দিকে প্রথমে রাজধানীর বারিধারায় মডেল পিয়াসার বাসায় অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। রাত পৌনে ১২টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর পিয়াসার দেওয়া তথ্যে মডেল মৌকে ধরতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ মদ উদ্ধার করা হয়। পরে রাত ১টার দিকে মৌকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ২৯ জুলাই মধ্যরাতে হেলেনা জাহাঙ্গীরের গুলশানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে র্যাব। ওইদিন রাত ২টার দিকে র্যাবের একটি দল মিরপুরে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন আইপি টিভি ‘জয়যাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন’ ভবনে অভিযান চালায়।