অতিমারি করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের ভেতরেও এগিয়ে চলেছে ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজ। প্রকল্পে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকরা দিনরাত কাজ করে চলেছে। এরই মধ্যে জাপান থেকে মেট্রোরেলের জন্য ১২টি বগি ঢাকায় আনা হয়েছে। বগিগুলোর সফলভাবে ট্রায়াল-রান সম্পন্ন হয়েছে। তীব্র যানজটের কবল থেকে রাজধানীবাসীকে মুক্তি দিতে নেওয়া এ প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে কাজের গতিও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা।
মেট্রোরেল প্রকল্প-৬ এর বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল এমআরটি-৬ এর কাজের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজ হয়েছে ৮৫ শতাংশ। মেট্রোরেলে কাজের সঙ্গে যুক্ত দেশি-বিদেশি কর্মীদের মধ্যে ৬৭০ জনের মতো করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, করোনায় আক্রান্তদের বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিতে পেরেছেন। কর্মীদের মধ্যে কেউ মারা যাননি। এটিকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নির্মাণকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি ২০২১ সালের বিজয় দিবসটি রাজধানীবাসীর জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই দিনই স্বপ্নের মেট্রোরেলে চড়বেন রাজধানীবাসী। রাজধানী ঢাকার চিরায়ত যানজটে তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করতে হবে না।
স্বপ্নের মেট্রোরেল নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গেই এ কথা জানালেন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তদারকির জন্য একাধিক টিম থাকলেও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই তদারক করছেন এ প্রকল্পের কাজ। কাজ এগিয়ে চলেছে পূর্ণমাত্রায়।
যানজটে নাকাল নগরবাসীর মনে একসময় এ মেট্রোরেল ছিল স্বপ্নের মতো। এখন আর এটি স্বপ্ন নয়, বাস্তব। পুরো মেট্রোরেল প্রকল্পকে দুই অংশে বিভক্ত করে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন জাপানি প্রকৌশলীরা।
একনজরে মেট্রোরেল প্রকল্প
সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা মেট্রোরেল ব্যবস্থাকে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) নামে একটি কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে সরকার। অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনতে এমআরটি স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়।
২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ‘মেট্রোরেল প্রকল্প’ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রকল্প ঋণ ৭৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ২৫ শতাংশ। ২০১৬ থেকে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাইকা। বাকি পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। মেট্রোরেল প্রকল্প লাইনের পুরো কাজ আটটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পে কাজের অগ্রগতি
প্রকল্পের কাজের অগ্রগতির বিষয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের পুরো কাজের ৬৪ শতাংশ শেষ হয়েছে। দুটি অংশে কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৮৫ শতাংশ। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজ হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। পাশাপাশি ইলেক্ট্রিক্যাল মেকানিক্যাল সিস্টেম ও রোলিং স্টক ও ডিপোর ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি প্রায় ৫৫ শতাংশ। ডিপোর কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের সাড়ে ১০ কিলোমিটার ভায়াডাক্টের ওপর বসানো হয়েছে রেললাইন। উত্তরা থেকে শুরু করে আগারগাঁও পর্যন্ত নয়টি স্টেশনের সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ ও পল্লবী স্টেশনের কনকোর্স ছাদ এবং প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের কাজ শেষ। মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও স্টেশনের কনকোর্স ছাদ ও প্ল্যাটফর্ম নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের কন্ট্রাক্ট প্যাকেজ-০৮ আওতায় এর জন্য ২৪টি যাত্রীবাহী রেলকোচ আমদানি করা হবে। প্রতিটি কোচে ছয়টি বগি থাকবে। ২৪ সেট ট্রেন তৈরি করছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি। প্রতি সেট ট্রেনের দুপাশে দুটি ইঞ্জিন থাকবে। এর মধ্যে থাকবে চারটি করে কোচ। ট্রেনগুলোয় ডিসি দেড় হাজার ভোল্ট বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা থাকবে। স্টেইনলেস স্টিল বডির ট্রেনগুলোতে থাকবে লম্বালম্বি আসন। প্রতিটি ট্রেনে থাকবে দুটি হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি বগির দুপাশে থাকবে চারটি করে দরজা। জাপানি স্ট্যান্ডার্ডের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত প্রতিটি ট্রেনের যাত্রীধারণ ক্ষমতা হবে এক হাজার ৭৩৮ জন। একটি স্টেশনে ট্রেন অবস্থান করবে ৪০ সেকেন্ড। উত্তরা থেকে মতিঝিলে এ ট্রেন আসতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। যাত্রীরা ফুটপাত থেকে সিঁড়ি, এসকেলেটর কিংবা লিফটে করে উঠতে পারবেন ট্রেনে।
রুট ও স্টেশন
সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মেট্রোরেলের চূড়ান্ত রুট হচ্ছে উত্তরা তৃতীয় ধাপ-পল্লবী, রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (চন্দ্রিমা উদ্যান-সংসদ ভবন) খামারবাড়ি হয়ে ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। সম্পূর্ণ রুটের ১৬টি স্টেশন থাকছে।
এগুলো হচ্ছে- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপু-১১, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিল। ট্রেন চালানোর জন্য বিদ্যুৎ নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে।
মেট্রোরেলের ট্রায়াল-রান
গত ১১ মে মেট্রোরেলের ট্রায়াল-রান করা হয়। এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মেট্রোরেলের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত, জাইকার প্রতিনিধি