সীমান্ত এলাকায় বাড়ছে করোনা রোগী, শয্যা ও আইসিইউ সংকট

1890
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

দেশের সীমান্তবর্তী জেলাসহ উত্তর ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে করোনায় সংক্রমণ, শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়ে গেছে। বিভিন্ন জেলায় করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়েছে। অনেক হাসপাতালে শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি থাকছেন। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছেন অনেকে। তাঁদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। অনেক রোগী চাহিদা অনুযায়ী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা পাচ্ছেন না। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় দুটি জেলা সম্পূর্ণ এবং সাতটি জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুটি জেলাতে বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে লকডাউন ঘোষিত এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে মানুষ উদাসীন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সীমান্তসহ কয়েকটি জেলায় করোনা পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে সামনে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরা জেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। করোনা রোগী বাড়তে থাকায় আরও ছয়টি জেলা লকডাউন করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি। জেলাগুলো হচ্ছে নওগাঁ, নাটোর, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও খুলনা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক সপ্তাহ ধরে করোনায় মৃত্যু আবার বাড়ছে। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলেও মৃত্যু বাড়ছে। বিভাগওয়ারি হিসাবে মৃত্যু বাড়ার হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহীতে। আগের সপ্তাহের তুলনায় রাজশাহীতে মৃত্যু বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। মৃত্যু বাড়ার হারে দ্বিতীয় স্থানে আছে খুলনা বিভাগ। এখানে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ৪২ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। আর ঢাকা বিভাগে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া রংপুরে ৬ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ৩ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। অন্যদিকে বরিশাল, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু কমেছে।

গত মে মাসে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর থেকে দেশে করোনা সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তুলনামূলকভাবে সংক্রমণ বেশি বাড়ছে। দেশে গত ৮ মে প্রথম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। সরকারি গবেষণায়, দেশে করোনার ৫০টি নমুনা পরীক্ষা করে সেগুলোর মধ্যে ৪০টি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) পাওয়া গেছে। সরকারের এই গবেষণাতে ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে পরিচিত ভারতীয় ধরনের সামাজিক সংক্রমণেরও (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) প্রমাণ পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের (এনসিডিসি) পরিচালক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, সংক্রমণ বন্ধ করতে পারাই চ্যালেঞ্জ। সামনে সংক্রমণ আরও বেড়ে যায় কি না, সেটিই বড় দুশ্চিন্তা। সংক্রমণ বেশি থাকা জেলাগুলোতে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়েছে। হাসপাতালে শয্যা, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

দুই জেলায় পুরো লকডাউন

গত ২৫ মে থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় লকডাউন চলছে। এর মধ্যেও করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সংক্রমণের হার ছিল ৫৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। আগের দিনের গড় হার ছিল ৪১ দশমিক ৬০ শতাংশ।

গতকাল শহরের নিমতলা মোড়, বড় ইন্দারা মোড়, পুরাতন বাজার মোড়, ডাকঘর এবং থানার সামনে মানুষ ও যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছি। খোদ সদর থানা ফটকের সামনেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জটলা করে মানুষজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকের মুখেই মাস্ক ছিল না। লকডাউনের বিধিনিষেধ যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। রিকশা, অটোরিকশা চলাচলও বেড়ে গেছে।

দুদিন আগেই ২৫০ শয্যার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যা ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়। আজ রোববার থেকে শয্যা বাড়িয়ে ৫০-এ উন্নীত করা হবে। করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত বলেন, ওয়ার্ডে এখন ১২ জন রোগীর অবস্থা জটিল। তাঁদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁদের এখনই আইসিইউতে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া দরকার। এ হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। রাজশাহীতেও পাঠানো যাচ্ছে না। কেননা সেখানে আইসিইউতে শয্যা ফাঁকা নেই।

সাতক্ষীরায় গতকাল শনিবার সকাল ছয়টা থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে। লকডাউনে নানা রকম বিধিনিষেধ দেওয়া হলেও তা মানতে দেখা যায়নি। সাতক্ষীরা শহরে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস চলাচল করেছে। কলারোয়ার কাজির হাট ও তালা উপজেলার পাটকেলঘাটায় সাতক্ষীরায় সীমান্তে দুটি পাহারাচৌকি বসানো হয়েছে।

সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, লকডাউনের প্রথম দিন কিছু পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। আমসহ অন্যান্য কাঁচা মালামাল পরিবহনে বিধিনিষেধ নেই।

স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা

নোয়াখালী পৌরসভা ও সদর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে প্রশাসনঘোষিত এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়েছে গতকাল সকাল ছয়টা থেকে। তবে প্রশাসনের এই বিশেষ লকডাউন দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ও দোকানপাট বন্ধ রাখা ছাড়া জনজীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

শহরের প্রধান সড়ক ও বিভিন্ন শাখা সড়ক ঘুরে দেখা যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের দখলে। শহরের প্রবেশপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও ততটা চোখে পড়েনি।

জেলা করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, মানুষজনের অবাধে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোতে সর্বোচ্চ দুজন যাত্রী পরিবহনে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে সরেজমিন পরিদর্শনের সময় অটোরিকশায় চালকসহ ছয়জন চলাচল করতে দেখা গেছে।

করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় মোংলা উপজেলাকে বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে। গতকাল শনিবার থেকে মোংলা উপজেলাজুড়ে বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। এ কাজে স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে মাঠে নেমেছে কোস্টগার্ড।

মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জীবিতেশ বিশ্বাস বলেন, শনিবার নতুন করে মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে ৪৮ জনের মধ্যে ৩৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এই হিসাবে, সংক্রমণ হার শতকরা ৭১ ভাগ।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলী, সাহাপুর, সাতপাড় ইউনিয়নের একাংশে লকডাউনের নবম দিন ছিল গতকাল। এসব এলাকার লোকজন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এলাকায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। অনেকে আড্ডা দিচ্ছেন চায়ের দোকানে।

নওগাঁ পৌরসভা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় সর্বাত্মক লকডাউন ও জেলার আরও তিনটি উপজেলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের তৃতীয় দিন ছিল গতকাল। আগের দুদিনের তুলনায় রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কিছুটা বেশি ছিল।

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের সাতটি গ্রামে প্রশাসনের অনির্দিষ্টকালের লকডাউন চলছে। গতকাল তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে পার্শ্ববর্তী কুড়ুলগাছি ও পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের নয়টি গ্রাম। এই নয়টি গ্রামে ১৪ দিনের জন্য লকডাউন দেওয়া হয়েছে। তবে লকডাউন দেওয়ার পরও মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সিন্দুর খান সড়কে সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লকডাউন করে রেখেছে উপজেলা প্রশাসন। এই জায়গায় চাঁপাইনবাবগঞ্জফেরত ৩৪ জনের করোনা পরীক্ষা করে ১২ জনের করোনা শনাক্ত হয়।

বিশেষ বিধিনিষেধ দুই জেলায়

খুলনা নগরের সদর, সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর থানা ও রূপসা উপজেলায় জেলা প্রশাসনের আরোপিত বিধিনিষেধের দ্বিতীয় দিন গতকাল বেশির ভাগ দোকানপাট-বিপণিবিতান বন্ধ ছিল। তবে প্রথম দিনের চেয়ে সড়কে যানবাহন এবং মানুষের আনাগোনা বাড়ে। কাঁচাবাজারে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতাও আগের মতো কম ছিল। দেখা গেছে, প্রধান সড়কগুলোতে বিধিনিষেধের কার্যকারিতা আছে। তবে পাড়া–মহল্লায় এবং বিভিন্ন মোড়ে ওষুধ ও মুদিদোকানের বাইরেও বিভিন্ন দোকান খোলা রাখতে দেখা গেছে।

করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রাজশাহী জেলাকে বিশেষ বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে। নতুন বিধিনিষেধ অনুযায়ী, সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত জরুরি পরিষেবা ও আম-সংক্রান্ত কার্যক্রম বাদে সবকিছু বন্ধ থাকবে। এ বিষয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশ তৎপর দেখা গেছে। তবে দিনভর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ছে না। ফলে মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন কম।

রোহিঙ্গা শিবিরে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি

কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ উপজেলা এবং পাঁচটি রোহিঙ্গা শিবিরে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হলেও তা ঠিকমতো পালিত হচ্ছে না। সড়কে চলছে ছোট–বড় অসংখ্য যানবাহন, হাটবাজার, দোকানপাট এবং বিপণিবিতানগুলোতেও মানুষের ভিড়।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অনুপম বড়ুয়া বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো মানা হচ্ছে না। কাজকর্মের জন্য রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে চলে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। শরণার্থীদের সেবায় যুক্ত এনজিও কর্মীরাও প্রতিদিন ক্যাম্পে যাওয়া–আসা করছেন। সংক্রমণ রোধ করতে হলে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পকে পৃথক করে কঠোর লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন