পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা না দিয়ে আইনের কঠোর প্রয়োগের তাগিদ

1862
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে প্রায় দেড় মাস হলো। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেটি এখনো বিপৎসীমার ওপরেই রয়েছে। এর মধ্যে ঈদুল ফিতরকে ঘিরে প্রথমে ঢাকা থেকে গ্রামমুখী ও পরে গ্রাম থেকে ঢাকামুখী মানুষের ঢলে সংক্রমণ আরও মাত্রাছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে ২৩ মে পর্যন্ত বিধিনিষেধ বাড়িয়েছে সরকার। তবে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে এখনো অনীহা রয়েছে মানুষের মধ্যে। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতেই পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে জনগণের মাস্ক পরার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পুলিশ পরিদর্শক থেকে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হবে। এই ক্ষমতা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই আইন সংশোধনের মাধ্যমে এই ক্ষমতা অর্পণ করা হবে পুলিশকে। আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিদ্যমান আইনেই পুলিশকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া আছে। তাদের আশঙ্কা, নতুন করে বিচারিক ক্ষমতা দিলে এর অপব্যবহার বাড়বে।

জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমাতে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন’। এই আইনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে। স্থানীয়ভাবে আইনটি প্রয়োগের কর্তৃত্ব রয়েছে জেলার সিভিল সার্জনদের হাতে।

প্রশাসনের একাধিক সূত্র বলছে, এই আইনেই কিছু সংশোধনী এনে সিভিল সার্জনদের পাশাপাশি পুলিশকেও ক্ষমতা দেওয়া উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আইনটি সংশোধন হলে কেউ মাস্ক না পরলে বা সরকারি বিধিনিষেধ না মানলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শাস্তি বা জরিমানা করতে পারবে। পুলিশ এ ক্ষেত্রে কী পরিমাণ শাস্তি দিতে পারবে বা কত টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে, সেটি সংশোধনীতে উল্লেখ করা হবে।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী মনজিল মোরসেদ বলেন, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বর্তমান যে আইনটি আছে, সেখানে যেকোনো স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করার জন্য কী পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে, তা বলাই আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের বিষয়টি আইন অনুযায়ী নির্দেশ দেওয়া হয়নি। ফলে সরকার যা ই বলুক, তা কেউ মানছে না, কেউ গুরুত্বও দিচ্ছে না।

তিনি বলেন, সরকার যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, তা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়নি। জনগণের জন্য দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, আসল উদ্দেশ্য হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আমাদের যে সরকারি কাঠামো বা সাংবিধানিক যে কাঠামো, সেখানে এমন কোনো সুযোগ নেই। কারণ তারা আইন প্রয়োগ করবেন। বিচারিক পর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করেন, বিচারিক ক্ষমতা তাদের থাকতে হবে। একজন পুলিশকে এ ক্ষমতা দেওয়া হলে তো বিচার বিভাগের মূল নীতি ব্যাহত হয়। আমার মনে হয়, অবশ্যই তারা এটা বিবেচনা করবেন। কোনোভাবেই যেন এটা তারা না করেন।

সংক্রামক ব্যধি নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগের দিকটি তুলে ধরে মনজিল মোরসেদ বলেন, আইন অনুযায়ী তারা উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিক যে মাস্ক না পরলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে। উপদেষ্টা কমিটিই পারে আইন বাস্তবায়ন করতে। তখন পুলিশই তাকে ধরে মোবাইল কোর্ট বা আদালতে পাঠাতে পারে। সে ক্ষমতা তাদের হাতে আছেই। এই ক্ষমতা নতুন করে দেওয়ার দরকার নেই। এখন আইনের যে দুর্বলতা রয়েছে তা হলো সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, যেখানে আইনি কোনো ফোর্স নেই। আইনে রয়েছে উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত দিতে হবে।

একই মত দিয়েছেন জেষ্ঠ্য আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, ২০০৩ সালে যখন র‌্যাব গঠন করা হয়, তখন দুই-চারজন দুষ্কৃতিকারীকে মেরে ফেলার পর কিছু জনগণ খুশি হয়েছে। কিন্তু এর ফল আমরা দেখছি। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যত বড় অপরাধীকেই মেরে ফেলা হোক না কেন, এটি কোনোদিন দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনবে না। একইভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তও সমর্থনযোগ্য নয়।

করোনা প্রতিরোধে সরকারের জারি করা বিধিনিষেধের সমালোচনা করে এই আইনজীবী বলেন, প্রশাসন যে নির্দেশনা দিয়েছে তা পরিপূর্ণ নয়। সবকিছু খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধ রাখার কারণ কী? লোকগুলো ঢাকা থেকে হেঁটে গেল, আবার ফিরছে। আমি কিছু খোল রাখব আবার কিছু বন্ধ রাখব— এটা তো হয় না। অর্থাৎ সমস্যাটা সিস্টেমে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে।

জেড আই খান পান্না আরও বলেন, পুলিশ সম্পর্কে সারা পৃথিবীতেই নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। পুলিশের চরিত্রই এখন এমন হয়েছে যে তাদের অবস্থান জনগণের বিরুদ্ধে। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও সাধারণভাবে মানুষ পুলিশকে নিজেদের বিপক্ষেই দেখে। এরকম একটি বাহিনীকে ক্ষমতা দিলে অরাজকতা তৈরি হবে। মানুষ আরও হয়রানির শিকার হবে। পয়সা না দিলে জেলে ঢুকবে। সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে বরং আইনের কঠোর বাস্তবায়ন কিভাবে করা যায়, সেদিকে নজর দিতে বলছেন তিনি।

পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে অবশ্য অবস্থান নিচ্ছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার আদেশ দিলে তা মানার দায়িত্ব নাগরিকদের। দেশে করোনা সংক্রমণের যে পরিস্থিতি, তা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে নিয়ম-কানুন তো মানতেই হবে। সরকারও এ বিষয়ে কনসার্ন। সরকারের নির্দেশনা জনসাধারণ না মানলে তো তার প্রতিকার থাকতে হবে। সে কারণে সরকারের এ উদ্যোগ যথোপযুক্ত।

পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, একে পুরোপুরি বিচারিক ক্ষমতা বলতেও নারাজ সাবেক এই আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, এটাকে বিচারিক ক্ষমতা বলা যাবে না। নিয়ম-কানুন ভাঙলে পুলিশ সবসময় নির্দেশ পালন করে, সেটা তো বিচারিক ক্ষমতা হলো না।

সূত্রে জানা গেছে, পুলিশকে বাড়তি এই ক্ষমতা দিতে বিদ্যমান আইনে কী ধরনের সংশোধনী দরকার, তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে তার প্রস্তাবনা চাওয়া হয়েছে। তবে পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা এখনই দেওয়া হচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। গণমাধ্যমকে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ক্ষেত্রে পুলিশের হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। তাই আলোচনা চলছে যে তাদের হাতে কিছু ক্ষমতা দেওয়া যায় কি না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। তার জন্য সময় লাগবে।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন