আত্মগোপনে থাকা মেয়র ও কাউন্সিলদের বরখাস্ত করে উপ-নির্বাচনের পরিকল্পনা

98
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অধিকাংশ সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার আওয়ামীলীগ মনোনীত মেয়র ও কাউন্সিলর এবং উপজেলা চেয়ারম্যানরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ দেশও ছেড়েছেন। সরকার পতনের দিন ৫ আগস্ট দুপুর থেকেই মোবাইল ফোনও বন্ধ করে দিয়েছেন বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি। একারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন উত্তরাধিকার সনদ, জন্মসনদ, চারিত্রিক সনদ, ট্রেড লাইসেন্মসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা নিতে আসা নাগরিকরা। থমকে গেছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও। স্থানীয় সরকার বিভাগের সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দায়িত্বে না ফিরলে আইন অনুযায়ী তাদেরকে বরখাস্ত করে উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। তবে আপাতত প্যানেল মেয়র মনোনীত করে তাদেরকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপরই আওয়ামী লীগের বিদায়ী মন্ত্রী, এমপি ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা গা ঢাকা দেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র, প্যানেল মেয়রসহ ১৭২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে মাত্র ১৮ জন বিএনপিপন্থি। ওই ১৮ জন ছাড়া অন্যরা কেউই ৫ আগস্টের পর থেকে অফিস করছেন না। তারা কোথায় আছেন তাও জানেন না সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) সংস্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেয়র ফজলে নূর তাপস সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাউন্সিলরদের নিয়ে গত বৃহস্পতিবার একটি সভা ডাকলে সেখানে সাধারণ ৭৫ কাউন্সিলরের মধ্যে প্যানেল মেয়রসহ ৬৫ জন উপস্থিত ছিলেন না। পরে সিইও বিএনপিপন্থি ১০ কাউন্সিলরকে নিয়ে দ্রুত নগরীর বর্জ্য অপসারণ, মশক কার্যক্রম এবং সড়কবাতি মেরামত বিষয়ে আলোচনা করেন। একই ভাবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও অফিসে আসছেন না। এখানে শুধু বিএনপিপন্থি ৪ জন কাউন্সিলর করপোরেশনে যাতায়াত করছেন। ফলে দুই সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক কর্মকাণ্ড, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ অধিকাংশ কার্যক্রমই বন্ধ রয়েছে। অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে অল্প কিছু কর্মচারী নিয়ে কোনোমতে চলছে শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মশক নিধন কার্যক্রম।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলর অফিসগুলোর কার্যক্রম চালু না থাকায় আর্থিক কার্যক্রম ও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সেবা বন্ধ আছে। দুই সপ্তাহের বেশি ছাত্র আন্দোলনে সড়ক, ফুটপাত এবং সড়কবাতি ভেঙে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, মেয়র ফিরলে তাঁর নির্দেশনায় কাজ করা হবে। তা না হলে নতুন উপদেস্টা যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা সেভাবে কাজ করবেন। ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, গত কয়েক দিন ধরে মেয়র-কাউন্সিলর অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। তবে গুরুত্ব অনুসারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিধন ও সড়কবাতি সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।

সরকারের পতনের পর থেকে আর কার্যালয়ে আসছেন না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ও অধিকাংশ ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। গা ঢাকা দিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও আওয়ামীলীগপন্থি কাউন্সিলররাও। এর ফলে এই দুই সিটির নাগরিক সেবা কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়রদের অনুপস্থিতিতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন সিটি কর্পোরেশনগুলোর পদস্থ কর্মকর্তারা। কারণ, সিটি করপোরেশনের অর্থসংক্রান্ত সব কাজ মেয়রের ওপর নির্ভরশীল। চেক সই ছাড়াও কেনাকাটার ব্যাপারে মেয়রের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। মেয়র না থাকায় জরুরি কেনাকাটাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার সেবা কোনোভাবেই বন্ধ রাখা ঠিক হবে না। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জোনাল অফিসের মাধ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় নাগরিক সেবা বন্ধ রাখা ঠিক হবে না। মেয়র না থাকলেও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জোনাল অফিসারদের মাধ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, যেহেতু অন্তর্ববতীকালিন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে তাই খুব দ্রুত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসা দরকার।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলররা অনুপস্থিত থাকায় নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী। এই স্থবিরতা কাটাতে মন্ত্রণালয়ের উচিৎ মেয়র ও কাউন্সিলরদের দ্রুত অফিস করার নির্দেশ দেওয়া। যদি মেয়র অফিস না করেন, তাহলে প্যানেল মেয়রদের মধ্য থেকে কাউকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র করা যেতে পারে। আর যদি ভারপ্রাপ্ত মেয়র করার মতো কেউ না থাকে তাহলে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসক নিয়োগ করা দরকার। নাগরিক সেবা দেওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলরদেরকে নির্দিষ্ট সময় দিয়ে কাজে যোগদানের জন্য নির্দেশনা দিতে হবে। যদি সে সময়ের মধ্যে না আসে তাহলে সরকার তাদের পদগুলো শূন্য ঘোষণা করতে পারবে।

সুুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিদায়ী সরকার আমলে সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনওতো সঠিক ভাবে হয়নি। তাই বর্তমান সরকারের উচিৎ হবে যেসকল জনপ্রতিনিধি পালিয়ে গেছে বা আত্মগোপনে আছে তারা দ্রুত দায়িত্ব পালনে ফিরে না আসলে তাদেরকে বরখাস্ত করে শূন্য পদে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তাহলে নাগরিক সেবা ব্যাহত হবে না।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দায়িত্বে না ফিরলে আইন অনুযায়ী তাদেরকে বরখাস্ত করে উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনে মেয়র ও কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতির ছুটি সংক্রান্ত ১৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে সরকার কোন মেয়রকে এবং মেয়র কোন কাউন্সিলরকে এক বৎসরে সর্বোচ্চ তিন মাস ছুটি মঞ্জুর করতে পারবেন। কোন কাউন্সিলর ছুটিতে থাকলে বা অন্য কোন কারণে অনুপস্থিত থাকলে উক্ত ছুটি বা অনুপস্থিতকালীন সময়ের জন্য মেয়র পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলরকে দায়িত্ব প্রদান করিতে পারবেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার কোন মেয়র ও কাউন্সিলর তিন মাস অফিসে অনুপস্থিত থাকলে আইন অনুযায়ী তাকে বরখাস্ত করা যাবে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে বা অসাদচারনের জন্যও মেয়র বা কোন কাউন্সিলরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে মন্ত্রনালয়।

এবিষয়ে জানতে চাইলে এলজিআরডি মন্ত্রনালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মহ: শের আলী জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রতিনিধিরা গা ঢাকা দেওয়ায় নাগরিক সেবা ব্যহত হওয়ার বিষয়টি মন্ত্রনালয়ের নজরে এসেছে। এবিষয়ে এলজিআরডি উপদেস্টার সঙ্গে মন্ত্রনালয়ের সচিব আলোচনা করে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

##

শেয়ার করতে ক্লিক করুন