নিজস্ব প্রতিবেদক:
তুলনামূলক নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রথম পছন্দ রেল। তাই যাত্রীর চাপ বেশি থাকায় বিভিন্ন রুটের ট্রেনের টিকিট মুহুর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তুু সেবার মান ও রাজস্ব আয় না বাড়লেও বছর বছর বেড়েই চলেছে সংস্থাটির পরিচালন ব্যয়। আয়ের চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয়ের কারণে ভারী হচ্ছে লোকসানের পাল্লা। গত ১৪ বছরে রেলের শুধুমাত্র পরিচালন লোকসান হয়েছে ১৮ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। এর সঙ্গে কোচ ও ইঞ্জিন কেনার টাকা এবং বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের বিনিয়োগের পরিমান যুক্ত করলে লোকসানের পরিমান বেড়ে আরও কয়েক গুণ বেশি হবে বলে সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মন্ত্রনালয়ের সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার পর কখনোই লাভের মুখ দেখেনি রেল। লোকসানের পাশাপাশি কমেছে রেলওয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও। ২৫ বছর আগে যেখানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে ৯৬ পয়সা ব্যয় করতে হতো সেখানে বর্তমানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে রেলওয়ের ব্যয় হচ্ছে ২ টাকা ৭৮ পয়সা। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুন। তাই বিনিয়োগ হওয়া অর্থ ফেরততো দূরের কথা, ট্রেন পরিচালনার খরচের অর্ধেকও তুলতে পারছে না সংস্থাটি। যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অনিয়ম দূর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে রেলে পরিচালন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি লোকসানও বাড়ছে। অনিয়ম বন্ধ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা না গেলে রেলওয়ের লোকসান কমানো সম্ভব হবে না। লোকসানের পরিমান কমাতে দূর্নীতি কমিয়ে ব্যয় সংকোচনের পাশাপাশি, পণ্যবাহী ট্রেন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে গত ১০ বছরে খরচ করা হয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। নতুন রেলপথ নির্মাণের পাশাপাশি কেনা হয়েছে নতুন বগি ও ইঞ্জিন। কিন্তুু বিনিয়োগ বাড়লেও সেবার মান যেমন বাড়েনি তেমনি কমানো যায়নি পরিচালন ব্যয়। রেলপথ মন্ত্রনালয় সুত্র জানায়, গত ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে রেলের আয় ছিল এক হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা ও পরিচালন ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এই অর্থ বছরে রেলের মোট পরিচালন লোকসান হয়েছে এক হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এর আগের বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেলে সরকারের খরচ হয় ১৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে রেলপথ নির্মাণ ও বগি-ইঞ্জিন কেনায় বিনিয়োগ ১২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। আর ট্রেন পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৬২ কোটি। বিপরীতে আয় ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। রেকর্ড ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান হয়েছে।
এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে রেলের পরিচালন লোকসান হয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। অথচ পঁচিশ বছর আগেও বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা আয় দিয়ে ট্রেন পরিচালনার সব ব্যয় মেটানোর পরও কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকত। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর রেলের পরিচালন উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা। আর বর্তমানে উদ্বৃত্ততো দুরের কথা লোকসান ছাড়িয়েছে হাজার কোটি টাকা। রেলের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০০৯ সাল থেকে বিগত ১৩টি বাজেটে রেলওয়ের জন্য ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে আয় হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। তাই ট্রেন পরিচালনায় ১৩ বছরে রেলের গচ্চা গেছে ১৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।
রেলপথ মন্ত্রনালয় সূত্র জানায়, মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে রেলের পরিচালন লোকসান দ্বিগুনেরও বেশি হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে পরিচালনার জন্য ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঐ বছরে পরিচালন লোকসানই হয়েছিল ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট আয় হয়েছিল ৯৫৬ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ লোকসান ছিল ৯২২ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছিল ৯৩১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। লোকসান ছিল ৮০৩ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আয় ছিল ৮০৪ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল ৮৮১ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৬২৯ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরেই রেলের লোকসান হাজার কোটি টাকা ছাড়ায় বলে সংস্লিষ্টরা জানান। তার আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৯৫৮ কোটি টাকা।
অথচ লোকসান কমাতে ২০১২ সালের ১ অক্টোবর থেকে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে কার্যকর করা হয়েছিল। এর পর অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল চালু হলে আয়-ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে এ যুক্তি দেখিয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলের ভাড়া আরেক দফায় ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। তবে ভাড়া বাড়ানোয় আয় কিছুটা বাড়লেও শেষ পর্যন্ত লোকসান কমেনি। এমন পরিস্থিতিতে কয়েক দিন আগে রেলপথ মন্ত্রী জিল্লুল হাকিম সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রেলের ভাড়া বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। লাগাতার লোকসান হলেও বিগত ৫ বছরে রেলের উন্নয়নে খরচ আরও বেড়েছে। এই সময়ে খরচ হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৬১ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। বাকি ১৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা রেল পরিচালনায় খরচ করে। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৬ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, রেল হচ্ছে মানুষের আগ্রহের একটি বাহন। লোকসান কমাতে হলে দূর্নীতি কমানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আয় বৃদ্ধি করে ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করতে হবে। আয় বৃদ্ধির উপায় হচ্ছে পণ্য পরিবহন বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি যাত্রীবাহী ট্রেনের সঙ্গে এক বা দুটি পণ্যবাহী কোচ দিতে হবে। স্ট্যান্ডিং টিকিটের টাকা যাতে সরকার পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, রেলে কোন কোন ক্ষেত্রে ১০ টাকার কাজে ৫০ টাকা বিল করার একটা প্রবনতা রয়েছে। মেশিনারিজ ও পার্টসসহ কেনা কাটার ক্ষেত্রে ভাল ভাবে অডিট করাতে হবে। কারণ কেনাকাটার ক্ষেত্রে খরচ বেশি দেখানো হয়। এসব অনিয়ম বন্ধ করার মাধ্যমে রেলকে লাভজনক করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, বিগত এক যুগে রেলে বিপুল পরিমান বিনিয়োগ হলেও মানোন্নয়নে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি সংস্থাটি। সমন্বয়ের অভাবের কারনে কোন কাজটি আগে করতে হবে আর কোনটি পরে করতে হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। পণ্য পরিবহন বাড়ানোর পাশাপাশি সুষ্ঠু সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আয় বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। একই সঙ্গে ট্রেনের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন করা উচিৎ ছিল। কিন্তু রেল এটা করতে পারেনি। উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়কে প্রাধান্য না দেওয়ার কারনে লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। এ জন্য শুধু রেল দায়ী নয়, পরিকল্পনা কমিশনেরও দায় রয়েছে।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) সাধারন সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, অনিয়ম বন্ধ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার করা না গেলে রেলওয়ের লোকসান কমানো সম্ভব হবে না। তাই সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি দূর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করতে পারলেই লোকসান থেকে রেহাই পেতে পারে রেল।
সাবেক রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেলের উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছে। এখনো অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে রেলের এই বিপুল বিনিয়োগের সুফল দ্রুত পাওয়া সম্ভব নয়। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। সুফল পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। চলমান প্রকল্পগুলো শেষ হলে রেলের সেবা বাড়ার পাশাপাশি লোকসানও কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
রেলপথ মন্ত্রী জিল্লুল হাকিম বলেন, রেলের পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী-আরএনবি, স্কুল ও হাসপাতালের ব্যয় বাড়ায় রেলের ব্যয় বেড়েছে, সেজন্য রেলের লোকসান কিছুটা বাড়ছে। এছাড়া নানা অব্যবস্থাপনার কারণেও রেলওয়েতে লোকসান হচ্ছে। অন্যদিকে রেলের যাত্রীবাহী ট্রেনের দৈনিক গড় আয় যেখানে সাড়ে তিন লাখ টাকা, সেখানে একটি মালবাহি ট্রেনের গড় আয় প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। তবে ৩৫০ টির অধিক যাত্রীবাহি ট্রেন চলাচল করলেও মালবাহি ট্রেন মাত্র ২০ থেকে ২৫টি চলাচল করে বিধায় রেলের আয় কিছুটা কম হচ্ছে। রেলকে লাভজনক করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।