বাধার পাহাড় টপকে কংগ্রেসকে নতুন পথ দেখাতে পারবে খাড়গে!

969
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

ভারতীয় লোকসভার ‘ক্যারিশম্যাটিক সাংসদ’ শশী থারুরকে হারিয়ে ভারতের শতাব্দী প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন দেশটির প্রবীণ রাজনীতিবিদ মল্লিকার্জুন খাড়গে। দলীয় সভাপতি নির্বাচনে থারুরের চেয়ে অনেক বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতে ভারতের বর্তমান প্রধান এ বিরোধী দলের দায়িত্ব নিয়েছেন খাড়গে। তবে তার সামনে অপেক্ষা করছে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। একদিকে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে সামাল দেয়া, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা সংকটে বিধ্বস্ত নিজের দলকে গুছিয়ে আনা। সব বাধা পেরিয়ে কংগ্রেসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে খাড়গে তার দলকে নতুন পথের দিশা দেখাতে পারবেন কি না, তা নিয়েই চলছে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ।

নির্বাচনে জেতার পর খাড়গেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী শশী থারুর। বলেছেন, ‘আমি ফল নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত। প্রাচীন এই দলে নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো। আজ থেকে আমাদের পার্টির পুনরুজ্জীবন শুরু হয়ে গেছে। আমি তাকে সমর্থন দেব।’

দুই দশকের মধ্যে এই প্রথম কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ। এর আগে ১৯৯৮ সালে সীতারাম কেশরী দলটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে পাঁচ বছরের মেয়াদ তিনি পূর্ণ করতে পারেননি। দুই বছরের মাথায় তাকে সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয়।

বোমা বিস্ফোরণে নিহত ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী সিতারাম কেশরীর স্থলাভিষিক্ত হন। এরপর থেকে ১৯ বছর তিনি দলের সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালে তার ছেলে রাহুল গান্ধী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তবে ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচনে দলের লজ্জাজনক পরাজয়ের পরে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে সোনিয়া গান্ধী অন্তর্বর্তী প্রধান হিসাবে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ খাড়গের জয় মোটামুটি প্রত্যাশিত ছিল।

কে এই মল্লিকার্জুন খাড়গে

মল্লিকার্জুন খাড়গের জন্ম ভারতের কর্ণাটকের এক দলিত পরিবারে। বেড়ে ওঠেন গুলবার্গ জেলায়। আইন নিয়ে পড়াশোনা করা খাড়গে ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৬৯ সালে তিনি কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেন। এছাড়া তিনি কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনেও প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তৎকালীন কর্ণাটক কংগ্রেসের প্রধান দেবরাজ উরস তাকে গুরমতিকাল এলাকা থেকে ১৯৭২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি করান। এলাকাটি ‘উচ্চবর্ণ’ অধ্যুষিত হলেও প্রায় ৯ বার এই আসন থেকে তিনি নির্বাচনে জিতেছেন।

ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইন্দুধরা হোন্নাপুরা জানান, খাড়গে দলিত নেতা হলেও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ তাকে সম্মান করে। খাড়গে বিভিন্ন সময় রাজ্য সরকারে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

অবসরপ্রাপ্ত একজন আমলা জানান, খাড়গে সবসময় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। তবে তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ছিল, যা তিনি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতেন। ২০০৯ সালে তিনি দিল্লির রাজনৈতিক কেন্দ্র-মঞ্চে চলে আসেন। এ সময় লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবারের মতো গুলবার্গ নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালেও এই আসন থেকে নির্বাচিত হন। তবে ২০১৯ সালে তিনি বিজেপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। ২০২১ সালে রাজ্যসভায় তাকে জয় পেতে সহায়তা করে কংগ্রস।

খাড়গে কি পারবেন বিজেপিকে টক্কর দিতে?

লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের দায়িত্ব পাওয়া খাড়গের দিকেই এখন তাকিয়ে পুরো দল। নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) টক্কর দিতে হলে কংগ্রেসে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এদিকে ৮০ বছরের খাড়গে এমন এক সময়ে দলের হাল ধরেছেন, যখন কাঠামোগত, সাংগঠনিক এবং আদর্শিকভাবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কংগ্রেস।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপিকে মোকাবিলা করতে তাকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। শুরুতেই তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি কেবল গান্ধী পরিবারের একজন প্রক্সি বা তাবেদার নন। এ ছাড়া দলের প্রতি নেতাকর্মীদের আস্থা ফেরাতেও কাজ করতে হবে তাকে।

কংগ্রেস ঠিকভাবে চলছে না বলে অভিযোগ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক প্রবীণ নেতা দলটি ত্যাগ করেছেন। তাদের বেশিরভাগই গান্ধী পরিবারের ওপর নাখোশ ছিলেন। এ ছাড়া দলে থেকেও গান্ধী পরিবারের সঙ্গে চরম মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল অনেকের, যাদের মধ্যে অন্যতম শশী থারুর।

খাড়গেকে এ ধরনের অনেক মতবিরোধ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এমনই একজন বিশ্লেষক কে বেনেডিক্ট। তিনি জানান, দলীয় কোন্দল মোকাবিলায় খাড়গে যথেষ্ট পারদর্শী। তিনি অন্যের সঙ্গে লড়াইয়ে যাওয়ার মতো মানুষ নন। তবে দক্ষিণ ভারত থেকে নির্বাচিত খাড়গে উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের মতো ভারতের উত্তরের রাজ্যগুলোতে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবেন না বলেও মনে করছেন অনেকে।

এদিকে খাড়গের সমালোচনা করে ভারতীয় সাংবাদিক পূর্ণিমা যোশী বলেছেন, কংগ্রেসের এখন যে অবস্থা তাতে জাতীয়ভাবে দলকে নতুন করে এগিয়ে নেয়ার মতো তেমন গতিশীলতা নেই নতুন সভাপতির। যোশীর মতে, খাড়গে খুবই শালীন মানুষ এবং শেকড় থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ। তবে কংগ্রেস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে যে শূন্যতা রয়েছে, তা পূরণ করার মতো অবস্থা তার নেই। ফলে তার পক্ষে মোদি-শাহকে চ্যালেঞ্জ জানানো কঠিন। কংগ্রেসের এমন একজন নেতা দরকার, যিনি বিজেপির ভাষায় কথা বলতে পারবেন কিংবা বিজেপি কোনো প্রশ্ন তুললে সেই ভাষাতেই উত্তর দিতে পারবেন। বিজেপিকে তাদের তৈরি ছকের মধ্যেই পরাজিত করতে পারবে, কংগ্রেসের দায়িত্বে এখন এমন মানুষ প্রয়োজন।

খাড়গের সামনে যত চ্যালেঞ্জ

চলতি বছরের শেষের দিকে ভারতের গুজরাট ও হিমাচল রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। গুজরাটে গত নির্বাচনে কংগ্রেস ১৭৭টি আসনের মধ্যে ৭৭টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে কংগ্রেসের বহু নেতা দলত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া আম আদমি পার্টি এই অঞ্চলে তাদের শক্তি বিস্তার করেছে। এতে শুধু বিজেপি নয়, এখন আম আদমি পার্টিও হয়ে উঠেছে কংগ্রেসের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।

এ ছাড়া হিমাচল প্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সেভাবে লড়াই করা সম্ভব হচ্ছে না কংগ্রেসের পক্ষে। ২০২১ সালে বীরভদ্র সিং মারা যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত ওই রাজ্যে কংগ্রেসের প্রধান নেতা কে হবেন, তা ঠিক করতে পারেনি দলটি।

ফলে এই দুই রাজ্যে কংগ্রেস যদি আবারও খারাপ ফল করে, তাহলে বড় হোঁচট খাবেন খাড়গে। এ ছাড়া ২০২৩ সালে কর্ণাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ে বিধানসভা নির্বাচন হবে। এই রাজ্যগুলোর ফল ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য কংগ্রেসের প্রস্তুতির ওপর প্রভাব ফেলবে।

যা ভাবছেন কংগ্রেস নেতাকর্মীরা
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং শশী থারুর উভয়ই ব্যস্ত প্রচারণা চালিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত, সারা দেশের ৬৭টি ভোটকেন্দ্রে ৯ হাজার ৯১৫ জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৯ হাজার ৩৮৫ জন তাদের ভোট দিয়েছেন। খাড়গে পেয়েছেন ৭ হাজার ৮৯৭ ভোট। অবৈধ ভোট ছিল ৪১৬টি।

কংগ্রেসের যে ২৩ জন সিনিয়র নেতা (জি-২৩) সভাপতি পদসহ বিপুল সংস্কার চেয়েছিলেন, তাদের অপ্রতিরোধ্য সমর্থন পেয়েছেন খাড়গে। এ ছাড়া প্রচারের শুরু থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাকে গান্ধী পরিবার এবং কংগ্রেসের বেশিরভাগ সদস্য সমর্থন দিচ্ছেন।

কংগ্রেস নেতারা বলছেন, দলের জন্য যা করা দরকার, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে গান্ধী পরিবারসহ দলের সব সিনিয়র নেতার সঙ্গে পরামর্শ করবেন খাড়গে। কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা অম্বিকা সোনি বলেছেন, ‘বড় দল চালানোর জন্য যে ধরনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, খাড়গের তা রয়েছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি একজন বিধায়ক, বিরোধী দলের নেতা এবং ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিলেন। তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার ক্ষমতা রাখেন।’

কংগ্রেস নেতা এবং রাজ্যসভার সদস্য প্রমোদ তিওয়ারি বলেছেন, ‘ব্রিটিশরা যে নিপীড়নের পথে হেঁটেছিল, বিজেপি সেই একই পথে চলছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, খাড়গে বিজেপি-আরএসএস মতাদর্শের উপযুক্ত জবাব দিতে পারবেন। আমি রাজ্যসভায় দেখেছি, বিজেপি সরকারের বিপক্ষে তিনি কীভাবে সিংহের মতো গর্জন করেন।’

গান্ধী পরিবারের ভূমিকা কী হবে?

বিশ্লেষকরা বলছেন, গান্ধী পরিবার কংগ্রেসের নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভোটের আগে খাড়গে সংবাদমাধ্যমকে জানান, দলীয় কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি গান্ধী পরিবারের কাছ থেকে নির্দেশনা চাইবেন না। তবে দীর্ঘদিন দল চালানোর অভিজ্ঞতা থাকায়, গান্ধী পরিবারের কাছে কিছু বিষয়ে পরামর্শ চাইতে পারেন বলে জানান তিনি।

এদিকে লোকসভার ভোটে রাহুল গান্ধীই দলের মুখপাত্র হতে যাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। কংগ্রেস নেতারা এটাও বলছেন, রাহুলের সঙ্গে খাড়গের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে।

কংগ্রেস কোষাধ্যক্ষ পবন কুমার বনসালের মতে, ‘জাতি ও দলের জন্য গান্ধী পরিবারের বড় অবদান রয়েছে। তাদের ত্যাগ আমরা ভুলতে পারি না। সোনিয়া গান্ধী দলের সভাপতি পদে থাকতে চাননি। আমরা রাহুল গান্ধীকে পার্টির সভাপতি হিসেবে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি রাজি হননি। এখন আমরা ব্যাপক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তির প্রতি আমাদের বিশ্বাস রেখে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি।’

শেয়ার করতে ক্লিক করুন