বহুমাত্রিক সম্পর্কের রোল মডেল ভারত-বাংলাদেশ

1203
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এটি শুধু ভৌগোলিক সীমারেখার কারণে নয়, এর পেছনে ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবিক ও সামরিক সহায়তা নিয়ে হাজির হয়েছিল ভারত। তখনই দুদেশের সম্পর্কের ভিত পাকাপোক্ত হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তরেখা রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্ববৃহৎ সীমান্ত ভাগাভাগি এ দুদেশের ‘বিশ্বাসযোগ্য’ পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নানা চ্যালেঞ্জে পড়েছে। দীর্ঘ এই সময়ে অনেক বাস্তবতা, নতুন নতুন অনেক অগ্রাধিকারের বিষয়ে সামনে এসেছে। চীন, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখনও অটুট। পৃথিবীর কাছে ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব পরীক্ষিত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য

ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দুর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের শীর্ষ ষষ্ঠ বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। গেল ২০২০-২১ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ভারত থেকে বাংলাদেশ মূলত কারখানার কাঁচামাল আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশের রফতানি এর ওপর নির্ভরশীল।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের রফতানি ১৮২ শতাংশ বাড়তে পারে। আর মসৃণ বাণিজ্য ব্যবস্থা ও লেনদেনের সুবিধা পেলে এটি ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে।

সংযোগ পরিকল্পনা

দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সংযোগ প্রকল্পগুলো এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তৈরি করবে। এরইমধ্যে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড (আইএমটি) হাইওয়ে প্রকল্পে যোগদানের বিষয়ে বাংলাদেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

ভারত এখন বাংলাদেশের মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করছে। ফলে দ্বিপাক্ষিক জলপথ বাণিজ্য বাড়বে। এদিকে বাংলাদেশকে ভারতীয় বন্দর ব্যবহার করে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে রফতানি করা থেকে বাংলাদেশকে নিরুৎসাহিত করছে ভারত। বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিনটি এক্সপ্রেস ট্রেন ও আন্তর্জাতিক বাস পরিসেবা চালু রয়েছে।

পীড়াদায়ক ইস্যু

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ‘মধুময়’ হলেও কিছু বিষয় বিষফোঁড়া হয়ে আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক সম্প্রীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ আশা করে, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে ভারত বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করার মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ভারত।

এ ছাড়া তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের অনুরোধে আশানুরূপ সাড়া দেয়নি ভারত। পশ্চিমবঙ্গের অপরাগতার কারণে ২০১১ সাল থেকে তিস্তার পানি চুক্তিটি স্থবির রয়েছে। শুধু তাই নয়, দুদেশে অভিন্ন ৫৪টি নদী রয়েছে। সে সব নদীর পানি বণ্টনেও সমস্যা রয়েছে।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অনিবার্য সম্পর্কও ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। বর্তমানে চীন-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় দিয়েছে চীন। বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় অবকাঠামো নির্মাণে চীনের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। চীন থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অস্ত্র আমদানি করে বাংলাদেশ, প্রথম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান।

সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়েও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সত্ত্বেও হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংস ঘটনা ঘটে। তবে সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকে। অন্যদিকে ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ফল

সম্প্রতি (৫-৮ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সন্ত্রাসবাদ, সীমান্ত অপরাধ ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি’ অব্যাহত রাখার বিষয়টি আলোচনা হয়। এ ছাড়া ভারত-বাংলাদেশ তাদের উন্নয়নমুখী অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ও অঞ্চল জুড়ে টেকসই সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি, কমপ্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সিইপিএ) ২০২২, বহুমুখী ট্রানজিট, বিদ্যুতের জন্য ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সংযোগ ও নতুন উদ্ভাবনের (স্টার্টআপ) ব্যাপারে ভারতের সহযোগিতাসহ নানা বিষয় প্রধানমন্ত্রীর সফরে উঠে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তা প্রশ্ন অধরা থাকলেও দুদেশের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য নদীর তথ্য বিনিময় ও পানি বণ্টন ব্যবস্থার কাঠামো তৈরি করতে দুদেশ সম্মত হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এক টুইট বার্তায় বলেছেন, আমাদের নেতৃত্বের উষ্ণতা ও ধারাবাহিকতা আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর সঙ্গে রয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকবে। এই সম্পর্কের ফলস্বরূপ সর্বশেষ পানি বণ্টন, রেলপথ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মহাকাশ, মিডিয়া ও সক্ষমতা বৃদ্ধির সহযোগিতাসহ সাতটি চুক্তি হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন ইস্যুতে প্রত্যাশিত সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি।

এ ব্যাপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতান মাহমুদ রানা সময় সংবাদকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘ ও ধারাবাহিক সম্পর্কের অংশ। একটি সফরে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে—এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। তবে ক্রমাগত সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গটি আজও চূড়ান্তভাবে অমীমাংসিত। এটি দুদেশের সম্পর্কের এক ধরনের ঘাটতি। সফরের সাফল্য বা ব্যর্থতা সব সময় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নিরিখে সাধারণ মানুষ বিচার করার চেষ্টা করলেও প্রকৃতপক্ষে তা করা উচিত নয়।

সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে

চলতি বছরের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে ভারত সফর করেছিলেন। এরপর ২০২১ সালের মার্চে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ডিসেম্বরে সে সময়ের ভারতীয় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বাংলাদেশ সফর করেন। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উপলক্ষে তারা বাংলাদেশ সফরে আসেন। দুদেশের এ সব সফর সম্পর্কে গতি সঞ্চার করেছে। সেইসঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরে কাজে লেগেছে।

কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সম্পর্কের উষ্ণতা এখন বেশি। অনেকে এটিকে দুই দেশের সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, দুদেশ যদি একে অপরের স্বার্থ বিবেচনা করে এগোয়, তাহলে অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে। এবং সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। সেক্ষেত্রে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান যেসব সমস্যা রয়েছে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমাধান করা সম্ভব। এ জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। বাংলাদেশ সরকার জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করছে। ভারতও বাংলাদেশকে উপেক্ষা করতে পারবে না, কারণ তাদের স্বার্থেই বাংলাদেশকে পাশে রাখতে হবে।

প্রশংসিত শেখ হাসিনা

এটি সত্য যে, কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আগামী ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সরকার ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের দাম ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বৈদেশিক রিজার্ভ ও মৌলবাদসহ নানা সংকটে মুখোমুখি হচ্ছে।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অন গ্লোবাল রিলেশনসের বিশিষ্ট ফেলো ও সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজিব ভাটিয়া বলেন, বাংলাদেশের জনগণ তাদের পরবর্তী সরকার নির্বাচন করবে। কিন্তু তাদের জানা উচিত, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান ভারতে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। আওয়ামী লীগ নেতারা যৌথভাবে ‘দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য একটি রোল মডেল’ তৈরি করেছেন। ভবিষ্যত যাই হোক না কেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সুরক্ষিত ও শক্তিশালী হওয়ার দাবি রাখে।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন