নিজস্ব প্রতিবেদক:
মাওয়ায় পদ্মার তীরে উন্মোচিত হল ফলক, বাতাসে উড়ল রঙিন আবির, বর্ণিল উৎসবে এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম অবকাঠামো পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার বেলা ১২ টায় মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর ফলক উন্মোচন করেন তিনি। দুই দশক আগে ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন হাসিনা। আর শনিবার শুধু উদ্বোধন নয় সেতুতে টোল দিয়ে তিনিই এ সেতুর প্রথম যাত্রী হয়েছেন। ২৩ দশমিক ৩২ মিটার প্রস্থ এ সেতুর উপর দিয়ে হালকা ও ভারী যানবাহন চলাচলের ৬টি লেন এবং নিচের অংশ দিয়ে ট্রেন চলাচলের লাইন রয়েছে। এসবের পাশাপাশি এ সেতুতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাস পরিবহণ লাইন রয়েছে।
সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা পদ্মা সেতু। দ্বিতল এই সেতুর এক অংশ পদ্মা নদীর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত এবং অপর অংশ নদীর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সড়কপথে সংযোগ তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর পাইলিং ও নদীশাসনের কাজ উদ্বোধন করেন। এরপর একে একে সব ধাপ পেরিয়ে পদ্মার বুকে ৪২টি পিলারের ওপর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে স্বপ্নের সেতু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জিডিপি ১.২ থেকে ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
শনিবার সকালে ঢাকার তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে করে মুন্সীগঞ্জরে মাওয়ায় পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়ায় সুধী সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার অতিথি সেখানে হাজির ছিলেন সকাল থেকেই। সুধী সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে ‘স্যালুট’ জানিয়ে বলেন, জনগণের সমর্থন আর সাহসেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি সম্ভব করা সম্ভব হয়েছে। এই সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এই সেতু দুই পাড়ের যে বন্ধন সৃষ্টি করেছে তা নয়, এই সেতু শুধু ইট, সিমেন্ট, স্টিল, লোহা, কংক্রিটের একটা অবকাঠামো নয়, এই সেতু আমাদের অহংকার, এই সেতু আমাদের গর্ব। এই সেতু আমাদের সক্ষমতা, আমাদের মর্যাদার শক্তি।
বক্তব্য শেষে মাওয়ার এই সমাবেশ থেকেই স্মারক ডাক টিকিট, স্মারক নোট, স্যুভেনির শিট, সিলমোহর ও উদ্বোধন খামের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীদের সঙ্গে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গ্রুপ ছবি তুলতে দাঁড়ান ক্যামেরার সামনে। সুধী সমাবেশ শেষ করে বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে ৭৫০ টাকা টোল দিয়ে প্রথম যাত্রী হিসেবে পদ্মা সেতু এলাকায় প্রবেশ করেন সরকার প্রধান। শুধু নিজের গাড়ির নয়, বহরে থাকা সবগুলোর গাড়ির মোট ১৬ হাজার ৪০০ টাকা টোল মেটান তিনি।
ফলক উদ্বোধনের পর সেখানে লাল গালিচায় ফটোসেশনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। তার সঙ্গে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদও ছিলেন এ সময়। এই উৎসবের ক্ষণে মায়ের সঙ্গে তাকে মোবাইল ফোনে সেলফি তুলতে দেখা যায়। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং ২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ ওঠায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং তখনকার যোগাযোগ সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূইয়াও উপস্থিত ছিলেন এ সময়। যদিও সেই অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি।
সেতুতে দাঁড়িয়ে মিগ-২৯ জঙ্গি বিমানের প্রদর্শনীও উপভোগ করেন সরকার প্রধান। উৎসবের এ মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরায় ধারণ করতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে। স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরীও সেতুর ওপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন এ সময়।
পদ্মা সেতুকে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে বর্ণনা করে ভারতীয় হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, এই সেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং উপ অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ বাড়াবে। শনিবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশের বৃহত্তম এই সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানান ভারতীয় হাই কমিশনার। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক এই দিনে বাংলাদেশের ভাই বোনদের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন এবং শুভকামনায় জানাই। এই পদ্মা সেতুর ফলে স্পষ্টতই বাংলাদেশ এবং উপ-অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি করবে। আমরাও এটি দেখে খুব আনন্দিত।