তেলকাণ্ডে গোয়েন্দা জাল, নজরদারিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা

1117
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক: আরেক দফা দাম বাড়ানোর পরও সংকট কাটেনি সয়াবিন তেলের। ঈদের আগে বোতলজাত সয়াবিন তেল যা-ও পাওয়া গেছে, এখন তো পাওয়াই যাচ্ছে না। রাতারাতি ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল। অথচ বাজার পর্যবেক্ষকদের হিসেবে, গত এপ্রিল মাসে বসুন্ধরা, সিটি ও মেঘনাসহ ৬টি কোম্পানি ৮ কোটি লিটার তেল সরবরাহ করেছে। যেখানে তেলে সয়লাব হওয়ার কথা সেখানে এখন তেলের জন্য সর্বত্রই হাহাকার। মূলত এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অবৈধভাবে মজুদ করেছে তেল। যার কারণে বাজারে তেল মিলছে না। তেলের বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার এটা কোনো ষড়যন্ত্র কিনা তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সয়াবিন তেলের মজুদদারদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

সূত্রমতে, নতুন করে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানোর পরও বাজারে এ পণ্যের হাহাকার দেখা দেয়ার ঘটনাটি খোদ সরকারও ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে দেখছে। এ পরিস্থিতিতে বাজার থেকে আকস্মিক তেল উধাও হওয়ার নেপথ্য কারণ এবং এর হোতাদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারা কোথায় অবৈধভাবে সয়াবিন মজুদ করে রেখেছে তা শনাক্ত করে ওইসব ঘাঁটিতে দ্রুত হানা দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, তারা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরিতে মাঠে নেমেছেন। তালিকা অনুযায়ী, প্রত্যেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গুদামে নজরদারি করা হবে। একইসঙ্গে প্রতিটি পাইকারি বাজারে সাদা পোশাকে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। ফটকা ব্যবসায়ীরা কেউ কোথাও সয়াবিন তেল মজুদ করে রেখেছে কিনা তা খোঁজ পেতে সোর্স নিয়োগ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অধিক মুনাফার আশায় যারা অবৈধভাবে সয়াবিন মজুদ করে বাজারে সংকট তৈরি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় গোয়েন্দারা বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে একাধিকবার বৈঠকও করেছেন।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, তারা রাজধানী ঢাকার ভেতরে যত পাইকারি বাজার রয়েছে, সেই তালিকা করে বাজার অনুযায়ী, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। তারা কে কতটুকু সয়াবিন তেল সংগ্রহ করে, সে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি কার কোথায় গুদাম রয়েছে, তা জানার চেষ্টা চালাচ্ছে। ছদ্মবেশে বা ক্রেতা সেজে সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা সংকট তৈরির মূল হোতাদের খুঁজে বের করার ছক তৈরি করছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড নজরদারি শুরু করা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের সব ইউনিটকে এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তারা সয়াবিন তেলের অবৈধ মজুদ করার বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছে। যা দ্রুত খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অবৈধভাবে কোথাও সয়াবিন তেল মজুদ করার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে সেখানে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো হবে। অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।

বাজার থেকে সয়াবিন তেল ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি খোদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও অস্বাভাবিক বলে মনে করছে। তাদের ধারণা, খুচরা ও পাইকারি ক্রেতারা অতি মুনাফা লাভের জন্য বিভিন্ন জায়গায় মাল স্টক করে রেখেছে। মূল্যবৃদ্ধির পর এখন তা তারা বাজারে ছাড়বে। তবে এজন্য তারা কিছুটা সময় নিচ্ছে। কেননা তাদের মালের গায়ে যে এমআরপি (খুচরা মূল্য) লেখা রয়েছে, তাতে নতুন রেটে তা বিক্রি করা কিছুটা কষ্ট হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব পণ্য জব্দ করতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা করছেন। তাই বাজার পরিস্থিতি বুঝে তারা এসব মাল দোকানে তুলবেন।

এ প্রসঙ্গে ভোজ্যতেলের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘আমাদের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখেন, মাল তুলে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা কে, কোথায় তা মজুদ করে রেখেছে।’ অবৈধভাবে মজুদকৃত সয়াবিন তেল বাজারে ছাড়া হলে কোনো সংকট থাকবে না বলে মনে করেন তিনি।

মজুদদাররা যে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রেখেছে তা গত কয়েকদিনের অভিযানে প্রমাণ মিলেছে। গত শুক্রবার খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার সোনাইপুল বাজারে এক ব্যবসায়ীর গুদামে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৫৭ হাজার লিটার সয়াবিন তেল পাওয়া গেছে। অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল মজুদের দায়ে আদালত মেসার্স খাঁন ট্রেডার্স নামের ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ফজলুল করিম পাটোয়ারীকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে। একই অপরাধে ওই বাজারের মেসার্স আলমগীর স্টোরকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

জানা গেছে, খাঁন ট্রেডার্সের ৪টি গুদামে ওই বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল পাওয়া যায়। অথচ ওই ব্যবসায়ীর কোনো ডিলিং লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স ছাড়া ডিলারশিপ ব্যবসা অবৈধ। বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফার জন্যই এভাবে বিপুল পরিমাণ তেল মজুদ করা হয়েছিল বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। গত ১ মে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর দুই হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, কারওয়ান বাজারে বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স নামের একটি পাইকারি দোকান থেকে এই সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়েছে। অথচ ওই দোকান থেকে এর কয়েকদিন আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, তাদের দোকানে কোনো সয়াবিন তেল নেই। এর একদিন পর অর্থাৎ ২ মে মুন্সীগঞ্জে দুইটি মুদি দোকান থেকে ৯ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম সোহাগ জানান, উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বাজারটির দোকানে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল মজুদ রেখে তেলের সংকট দেখিয়ে তা বাজার মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করার সংবাদে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। তবে সিদ্বেশ্বরী বাজারে অভিযানের খবর পেয়ে উপজেলার হাসাইল ও পাঁচগাঁও বাজারের দোকানদাররা দোকান বন্ধ করে সটকে পড়েন। ওইসব দোকানেও বিপুল পরিমাণ সয়াবিন মজুদ থাকতে পারে বলেও মনে করেন স্থানীয়রা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে মার্চের মাঝামাঝিতে বাজারে তেল সংকট দেখা দেয়। এসব ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ভোক্তা অধিদফতর বিভিন্ন গুদাম, দোকান ও বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধভাবে মজুদকৃত সয়াবিন তেল জব্দ করে। এতে কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। তাই ফের অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হলে বাজারে তেলের যে কৃত্রিম সংকট রয়েছে তা দূর হয়ে যাবে। তবে এ ধরনের অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার তাগিদ দিয়েছেন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, বাজারে এমনভাবে নজরদারি করতে হবে যাতে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি না হয়, আবার অসাধু ব্যবসায়ীরাও যাতে কোনো কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে। অর্থাৎ দুষ্ট দমনের পাশাপাশি শিষ্টের পালন করতে হবে। ভালো ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতে হবে। আর খারাপ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই বাজারে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিয়মিত দাম সমন্বয় করতে না পারার কারণেই মূলত দেশে সয়াবিনের বাজারে এমন অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন, সয়াবিনের বাজার সামাল দিতে সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। শেষমেশ উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করেছে, আমদানিতে কর কমিয়েছে। কিন্তু আমদানি ও সরবরাহের দিকে নজর দেয়া হয়নি। উল্টো বলা হয়েছে সয়াবিনের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। যদি তাই হয় তা হলে সয়াবিন গেল কোথায়?

বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) কামরুজ্জামান রাসেল বলেন, ‘সয়াবিন তেলের অবৈধ মজুদ বন্ধে পুলিশ সদর দফতর থেকে সারাদেশে পুলিশের সব ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাজার অস্থিতিশীল করার অভিসন্ধি নিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউ সয়াবিন তেল মজুদ করলে তা জব্দ করা হবে। তবে এসব অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে পুলিশকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যাতে এ নিয়ে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। বাজার কিংবা কোনো গুদামে অভিযান চালানোর সময় প্রয়োজনে বাজার কমিটি বা দোকান মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে নেয়া হবে। যাতে এ ইস্যুতে বিশেষ কোনো চক্র ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে।’

শেয়ার করতে ক্লিক করুন