যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপকে পাত্তা দিচ্ছে না সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক

1209
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

ইউক্রেনে সেনা পাঠানোয় অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পাশাপাশি রাশিয়ার তেল রফতানির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। ফলে বিশ্বজুড়ে টালমাটাল জ্বালানির বাজার। ফের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

রাশিয়া এককভাবে ইউরোপের প্রধান তেলের যোগানদাতা হওয়ায় তেলের জন্য এখন হন্যে হয়ে রাশিয়ার বিকল্প উৎসের সন্ধান করছে পশ্চিমারা।

এ পরিস্থিতিতে তারা সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেকের শরণাপন্ন হয়েছে। রাশিয়ার তেলকে প্রতিস্থাপন করতে ওপেক দেশগুলোকে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আপাতত পশ্চিমা চাপে মাথানত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বৃহস্পতিবার (৫ মে) ওপেক ও ওপেকের বাইরের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের বৈঠকেই এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।

বৃহস্পতিবারের বৈঠকে আগামী জুন থেকে প্রতিদিন অতিরিক্ত মাত্র ৪ লাখ ৩২ হাজার ব্যারেল তেল উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয় ওপেক প্লাস। বিশ্ববাজারে রাশিয়ার প্রতিদিনের যোগান দেওয়া ৭০ লাখ ব্যারেল তেলের তুলনায় যা একদমই অপ্রতুল।

পাশাপাশি বৈঠকে ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা না থাকার বিষয়টিও পরিষ্কার করেছে দেশগুলো। তাদের মতে কোভিড লকডাউন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে তেলের সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।

বৃহস্পতিবারের ওপেক প্লাসের বৈঠকে রাশিয়াও অংশ নেয়। ওপেকের সদস্য রাষ্ট্র না হলেও বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া। ফলে ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তে মস্কো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

এদিকে এ পরিস্থিতিতে ফের অস্থির হয়ে পড়েছে বিশ্বের তেলের বাজার। মাত্র একদিনের ব্যবধানে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেল প্রতি ছয় ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।

এর আগে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত মার্চ মাসে রাশিয়ার জ্বালানি রফতানির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণায় সাময়িক সময়ের জন্য তেলের দাম ব্যারেল প্রতি রেকর্ড ১৩৯ ডলারে উঠে গিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা না দেওয়ায় তেলের দাম ফের কমতে থাকে। এ পর্যায়ে তা নেমে আসে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের নিচে। কিন্তু চলতি সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন করে রাশিয়ার তেল রফতানির ওপর অবরোধের প্রস্তাব দিলে গত কয়েকদিন ধরে ফের তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

এ পরিস্থিতিতে ওপেক দেশগুলোর প্রতি তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দুই উপসাগরীয় দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি সবচেয়ে বেশি চাপ ছিল। কারণ এ দুইটি দেশের বর্তমান উৎপাদনের থেকে তাদের উৎপাদনের সক্ষমতা অনেক বেশি।

কিন্তু আপাতত এ ব্যাপারে দেশ দুইটির কোনো আগ্রহ নেই বলে বোঝা যাচ্ছে। বৃহস্পতিবারের ওপেক প্লাস বৈঠকে রাশিয়ার তেল রফতানির ওপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত কোনো আলোচনাই হয়নি বলে জানা গেছে। ফলে বর্তমানে এটা পরিষ্কার হলো, রাশিয়ার তেলের বিকল্প হিসেবে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর মার্কিন ও ইউরোপীয় চাপকে পাত্তাই দিচ্ছে না ওপেক।

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওপেক ও ওপেক প্লাস দেশগুলো ইউক্রেন সংকটকে নিজেদের সমস্যা হিসেবে দেখতে রাজি নয়। তাদের মতে, এটা পশ্চিমাদের সমস্যা তাদেরকেই সেটা মোকাবিলা করতে হবে। পশ্চিমাদের সমস্যার দায় ওপেক বা ওপেক প্লাস নেবে না।

এ বিষয়টি বৈঠকের আগে বুধবার (৪ মে) ওপেকের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ বারকিন্দোর বক্তব্যেও প্রতিফলিত হয়। তিনি বলেন, তাদের পক্ষে প্রতিদিন বিশ্ববাজারে রাশিয়ার ৭০ লাখ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম পণ্যের বিকল্প যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। ওপেকের এ পরিমাণ সামর্থ্য নেই।

এ পরিস্থিতিতে উপায় না দেখে পশ্চিমা দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি গত মাসে তাদের স্টকে থাকা তেল বিশ্ববাজারে ছাড়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এ পদক্ষেপ সাময়িক সময়ের জন্য কাজ করলেও রাশিয়ার তেলকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়নি। ফলে তেলের দাম বর্তমানে ফের বাড়তির দিকে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বারবার তাগাদা সত্ত্বেও কেন ওপেক তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করছে না সে বিষয়টিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে যেখানে ওপেকের প্রধান তিন উৎপাদনকারী সৌদিআরব, ইরাক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে পশ্চিমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মূলত বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বাধীন এ দেশগুলো ইদানীং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে আর বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না।

ইউক্রেন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বারবার সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি তেলের উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। কিন্তু তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি আবুধাবি ও রিয়াদ।

বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সৌদি আরবের যুবরাজ আব্দুল্লাহর সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বিশেষ করে গত বছর বাইডেন সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের গোপন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। যেখানে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি যুবরাজের সরাসরি যোগাযোগকে নির্দেশ করা হয়। এর পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি তুঙ্গে ওঠে।

অথচ দুই দেশেরই অতিরিক্ত তেল উৎপাদনের ব্যাপক সক্ষমতা রয়েছে উল্লেখ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপসাগরীয় দেশগুলো আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চলতে চাচ্ছে না। চীন ও রাশিয়ার উত্থানের কারণে তারা এখন ধীরে ধীরে পশ্চিমাদের বলয়ের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

এ পরিস্থিতিতে এমনকি শত্রু রাষ্ট্র ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের শরণাপন্ন হয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ দেশ দুইটি বিপদের বন্ধু রাশিয়ার দুর্দিনে মস্কোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ওপেক যদি তেলের উৎপাদন নাটকীয়ভাবে না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় আর যদি সত্যিই ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর অবরোধ দেয়, তবে রাতারাতি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১৩০ ডলার থেকে ১৫০ ডলারে পৌঁছে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যা ইউরোপের শিল্প উৎপাদনকে চূড়ান্তভাবে ব্যাপকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন