একাত্তরে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বড় বাধা বলে মন্তব্য করেছেন, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ডক্টর হাছান মাহমুদ।
সকালে চট্টগ্রামের ষোলশহরে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত গণহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় মন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়াসহ তাদের নেতারা একাত্তরে শহিদদের সংখ্যা ৩০ লাখ কিনা বিভিন্নসময় সে প্রশ্ন তুলেছেন। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করে। না হলে অনেক আগেই গণহত্যার স্বীকৃতি মিলতো।
২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানিয়ে আসছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯৩ সাল থেকেই কালরাত পালনের কর্মসূচি শুরু করে নির্মূল কমিটি। কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জানান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তারা ২৫ মার্চের পক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরেছেন।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার রাষ্টÌবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অ্যাডাম জোনস বলেছেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হলেও তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি আজও; বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ’ হিসেবে দেখার তীব্র প্রবণতা রয়েছে।’ ২০১৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পরে, ঢাকায় এ কথাগুলো বলেছিলেন অ্যাডাম জোনস। বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি এখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।
তবে সংজ্ঞাগত ও তাত্ত্বিকভাবেই বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কোনো কারণ নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন ‘দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে’ গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া- এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে।
কানাডা ও আর্জেন্টিনা ছাড়াও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত নির্মম গণহত্যার বিষয়টি ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ও গবেষণা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি ও ডিপল ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকোরি, ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লজে গণহত্যার বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের গণহত্যাকে ইয়েলের পাঠ্যসূচিতে স্হান দিতে ভূমিকা রেখেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক বেন কিয়েরনান। শাহরিয়ার কবির পরিচালিত তথ্যচিত্র ওয়ার ক্রাইম ১৯৭১-এ তিনি এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ২০ শতকের শেষদিকে বাংলাদেশের গণহত্যা ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সালে এবং পূর্ব তিমুরে ১৯৭৫ সালে সংঘটিত গণহত্যার মতোই ভয়াবহ।
জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক আবেদনের আহ্বান
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বাংলাদেশের সরকারকে অবিলম্বে জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন জানানোর দাবি জানিয়েছেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম—মুক্তিযুদ্ধ‘৭১ এর নেতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতি-জাতিসংঘের ব্যর্থতা’ শীর্ষক সেমিনারে তারা এই দাবি জানান। সংগঠনের নেতারা বলেছেন, জাতিসংঘ ১৯৭১ সালের আগের, এমনকি পরেরও বহু গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার ফলে জাতিসংঘ তার প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সেমিনারে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাষ্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, আর বিলম্ব না করে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানাতে হবে। লেখক ও সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করে জাতীয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকারকে জাতিসংঘের কাছে আবেদন করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন, জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ে সরকারকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। অন্যথায় এই স্বীকৃতি মিলবে না।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সংঘটিত অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে এবছর স্বীকৃতি দিয়েছে ‘জেনোসাইড ওয়াচ’ এবং ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’। সংস্হা দুটি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্যও আহ্বান জানিয়েছে।