নতুন একটি আইনের প্রস্তাব করেছে সরকার।এতে জমিজমা সংক্রান্ত ২৪ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে নানা মেয়াদে শাস্তির বিধান থাকছে। পাশাপাশি জরিমানারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন-২০২১’ নামের আইনটির খসড়া মতামত গ্রহণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘এই আইন কার্যকর হলে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ কমে যাবে। ফলে জমিজমা সংক্রান্ত মামলাও অনেক হ্রাস পাবে।
দেশে এই মুহূর্তে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখের মতো। এসব মামলার প্রায় ৬০ শতাংশ জমিজমা সংক্রান্ত নানা ধরনের বিরোধের সূত্রে করা। সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, বিচারাধীন মামলার ৬০ শতাংশের বেশিই জমিজমা সংক্রান্ত। অধিকাংশ মামলার ‘রুট’ হচ্ছে জমি নিয়ে।
এসব অপরাধের অনেকটি এখন দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেগুলোর বিচার হতেও অনেক সময় লাগে। কিন্তু নতুন আইনটি পাস হলে এগুলো ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে শনাক্ত করে দ্রুত বিচার করা যাবে। রীতি অনুযায়ী, এরপর সেটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। সেখানে অনুমোদিত হলে সেটা আইন হিসেবে পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করা হবে।
আইনে যেসব অপরাধ ও দণ্ডের প্রস্তাব
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ভূমির জবরদখল, ক্ষতি, জাল কাগজপত্র তৈরি করে জালিয়াতি বা প্রতারণা বন্ধ করাই এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাস করে জনগণের ভোগান্তি দূর করা এবং ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধ ও দ্রুত প্রতিকার দেয়ার জন্য আইনটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
এসব অপরাধের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্য আইনে যা কিছু বলা হোক না কেন, এই আইন সেখানে প্রাধান্য পাবে। এসব অপরাধ ফৌজদারি কার্যবিধির মতো সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এই আইনের প্রয়োগ করা যাবে।
প্রস্তাবিত ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২১ আইনে যেসব অপরাধে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর জন্য যে সাজা প্রস্তাব করা হয়েছে-
১. জাল দলিল তৈরি
যদি কেউ ব্যক্তি মালিকানাধীন বা সরকারি খাসভূমি অথবা কোনও প্রতিষ্ঠানের জমির দলিল জাল করেন, তাহলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২. মালিকানার অতিরিক্ত জমির দলিল সম্পাদন
কোনও ব্যক্তি যতটুকু জমির মালিকানা রয়েছে, যদি এর চেয়ে বেশি দলিল করেন, তাহলে তার দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
৩. একই জমি একাধিকবার বিক্রয়
কোনও ব্যক্তি যদি তার বিক্রিত জমি পুনরায় বিক্রি করার উদ্দেশ্যে দলিল করেন, তাহলে তার দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, তিন থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এটি জামিন অযোগ্য অপরাধ হবে।
৪. বায়নাকৃত জমির পুনরায় চুক্তি করা
বিক্রয় চুক্তি বা বায়না চুক্তি করার পর অন্য কোনও ব্যক্তির সঙ্গে আবার চুক্তি করলে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, তিন থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৫. ভুল বুঝিয়ে দানপত্র
ভুল বুঝিয়ে বা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অথবা প্রতারণা করে যদি কোনও ব্যক্তি অন্য আরেকজনের কাছ থেকে জমির দান দলিল করেন, তাহলে সেটা একটা অপরাধ হবে। সেজন্য ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
৬. সহ-উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজের নামে দলিল
উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, অন্যকে বঞ্চিত করে নিজের হিস্যার চেয়ে বেশি জমি দলিল করা হলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারেন।
৭. সহ-উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজের প্রাপ্যতার চেয়ে বেশি জমি বিক্রি
উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, অন্যকে বঞ্চিত করে নিজের হিস্যার চেয়ে বেশি জমি বিক্রি করলে সেটা অপরাধ হবে। সেজন্য ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারেন।
৮. অবৈধ দখল
বৈধ কাগজপত্র না থাকার পরেও কেউ যদি ব্যক্তি মালিকানাধীন, সরকারি খাস ভূমি বা কোনও সংস্থার জমি জোর করে দখল করে রাখেন, সেজন্য এক বছর থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
৯. সহ-উত্তরাধিকারীর জমি দখল করে রাখা
কোনও ব্যক্তি যদি তার শরীক বা সহ-উত্তরাধিকারীর প্রাপ্য জমি জোর করে দখল করে রাখেন, সেজন্য ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
১০. অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালি উত্তোলন
বেআইনিভাবে সরকারি বা বেসরকারির ভূমি, নদীর পাড়, তলদেশ ইত্যাদি থেকে মাটি বা বালু উত্তোলন করলে (কোনও ক্ষতি হোক বা না হোক) অপরাধ হবে। সেজন্য ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারেন।
১১. জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করার শাস্তি
বেআইনিভাবে মাটি ভরাট করে বা অন্য কোনোভাবে জলাবদ্ধতা তৈরি করলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেজন্য ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
১২. বিনা অনুমতিতে জমির ওপরের স্তর কেটে নেয়া
জমির মালিকের অনুমতি ছাড়া যদি ওপরের স্তর থেকে মাটি উত্তোলন করা বা করানো হলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
১৩. অধিগ্রহণের পূর্বে অতিরিক্ত মূল্যে জমির দলিল
কোনও এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে, এমন খবর জানতে পেরে কেউ যদি সরকারি নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে ভূমি নিবন্ধন করেন, তাহলে সেটি একটি অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেজন্য ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
১৪. জনসাধারণের ব্যবহার্য বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জমি দখল
খেলার মাঠ, জলাশয়, কবরস্থান, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, দরগা, শিক্ষা বা ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি দাতব্য বা জনপ্রতিষ্ঠানের জমি দখল, সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ করা বা করতে সহায়তা করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারেন।
১৫. বিনা অনুমতিতে পাহাড় বা টিলার পাদদেশে বসতি
অনুমতি ছাড়া কোনও পাহাড় বা টিলার পাদদেশে বা পাহাড়ে বসতি স্থাপন করা হলে তাকে যেকোনও সময় উচ্ছেদ করা যাবে। অবৈধভাবে বসতি স্থাপনের জন্য তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে।
১৬. রিয়েল এস্টেট কর্তৃক জমি বা ফ্ল্যাট হস্তান্তর সংক্রান্ত অপরাধ
একই জমি একাধিক ব্যক্তির বরাবর দলিল করে দেয়া, চুক্তি মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ে জমির দলিল দিতে না পারা, ফ্ল্যাট বিক্রয়ের পর ঘোষিত সময়ের মধ্যে হস্তান্তর করতে না পারা, ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হলেও দলিল দিতে ব্যর্থ হওয়া-ইত্যাদি কর্মকাণ্ড অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেজন্য ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
১৭. চুক্তির পর ভূমি মালিককে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেয়া
জমির মালিকের সঙ্গে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি চুক্তি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমি মালিকের অংশ তাকে বুঝিয়ে না দিলে বা দখল না দিলে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
১৮. সরকারি-বেসরকারি বা সংস্থার জমির বেআইনি দখল
এরকম কর্মকাণ্ড করা হলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ থেকে চার লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
১৯. নদী, হাওর, বিল বা জলাভূমির ক্ষতি
মাটি, বালি বা আবর্জনা দ্বারা, অন্য কোনও পদার্থ বা উপায়ে কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ করে নদী, হাওর, বিল অথবা জলাভূমির আংশিক ক্ষতি করা হলে অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড, অনধিক এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
আর সম্পূর্ণ ক্ষতি করা হলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
২০. অবৈধ দখল গ্রহণ ও বজায় রাখতে পেশিশক্তি
অস্ত্র প্রদর্শন, প্রাণনাশের হুমকি ইত্যাদি দেয়া হলে সেটি জামিন অযোগ্য অপরাধ হবে। সেজন্য ছয় মাস থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
২১. পুনরায় অপরাধ করা
এই আইনের অধীন কোনও অপরাধে একবার সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর পুনরায় সেই অপরাধ করলে আগে যে ধারায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে, তার দ্বিগুণ শাস্তি হবে।
২২. বেশি জমি লিখিয়ে নেয়া
এক্ষেত্রে যদি জমির পরিমাণ এক একরের বেশি হয় এবং ল্যান্ড ডেভেলপার বা রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার জড়িত থাকে, তাহলে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
২৩. প্রতিবেশী ভূমি মালিকের ক্ষতিসাধন
কেউ যদি সহ-মালিক বা পাশাপাশি থাকা জমির ক্ষতি করেন কিংবা কোনও পরিবর্তন আনেন, তাহলে এক বছর থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, তিন লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
২৪. অপরাধ সংঘটনে সহায়তা বা প্ররোচনা
এই আইনের বর্ণনা করা যেকোনও অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে সেই ব্যক্তিরও অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তির মতো সাজা হবে।