কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং ক্যাম্পে সশস্ত্র দুর্বত্তদের গুলিতে রোহিঙ্গাদের অন্যতম শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ নিহত হয়েছেন। ক্যাম্পে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটলিয়ন ১৪-এর কমান্ডিং কর্মকর্তা পুলিশ সুপার নাইমুল হক এ তথ্য জানান।
মহিবুল্লাহর স্ত্রীর বরাত দিয়ে তিনি জানান, বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুতুপালং শিবিরে তাদের বাড়িতে ৪ থেকে ৫ জন লোক আসেন। তারা তাকে (মহিবুল্লাহ) লক্ষ্য করে ৪ থেকে ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়েন।
৪৭ বছর বয়সী মহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর সারারাত ক্যাম্পে তার অনুসারীরা অবস্থান নেন।
পুলিশ সুপার নাইমুল হক জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অল্প জায়গায় অনেক মানুষ থাকেন। তাই গোলাগুলি ও হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়তেই আশেপাশের বহু মানুষ ঘটনাস্থলে ভিড় জমান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। কিছুক্ষণ পরই তা স্বাভাবিক হয়।
বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) তিনি জানান, এদিন সকালে আবার কিছু উৎসুক মানুষ ঘটনাস্থলে জড়ো হন। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে তার পরিচিতরা জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘হত্যাকারীরা মহিবুল্লাহর কাছে যেতে পেরেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন। তাই তারা পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন বলেই প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হচ্ছে।’
তবে মুহিবুল্লাহকে হত্যার সঙ্গে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) জড়িত বলে দাবি করেছেন তার ভাই হাবিবুল্লাহ। তিনি অভিযোগ করেন, মুহিবুল্লাহর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে খুন করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেনারেল হাসপাতালে মুহিবুল্লাহর মরদেহের ময়নাতদন্ত চলছে। এরপর তা নেয়া হবে কুতুপালং ক্যাম্পে। সেখানে নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে। ইতোমধ্যে তার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ধরতে অভিযানে নেমেছে এপিবিএন ও পুলিশ।
মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করে মহিবুল্লাহর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস। ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের ভাষ্যমতে, শরণার্থী শিবিরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দাবি-দাওয়া তুলে ধরতো তার সংগঠন।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রণ পান মহিবুল্লাহ। সেসময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য হোয়াইট হাউসেও আমন্ত্রণ পান তিনি।
যেভাবে উত্থান মুহিবুল্লাহ’র: রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। যারা এক সময় ছিল না কোনো পরিচয়। যিনি মিয়ানমার থেকে ১৯৯২ সালে পালিয়ে কক্সবাজার এসেছিলেন। দীর্ঘ সময় শান্তভাবেই বসবাস করেন এই নেতা। কিন্তু তার অবস্থার পরিবর্তন আসে ২০১৭ সালের পর।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলার শিকার হয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ সরকার। এরপর পুরো বিশ্বের কাছে কক্সবাজার হয়ে ওঠে এক পরিচিত জেলা।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভয়াবহ সেই দুরাবস্থার কথা জানতে এবং তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে বিশ্বের আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ অনেক এনজিও। এরপরই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর চিত্র আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকে।
জানা যায়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে না যেতে পারার পেছনে বেশ কিছু বিদেশি এনজিও এবং কয়েকজন ব্যক্তির হাত রয়েছে। আর তাদেরই একজন হলেন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ। যিনি সাধারণ মানুষ থেকে শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতা বনে গেছেন।
গতকাল বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যানকে কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে গুলি করা হয়।
১৯৯২ সালে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার পর টেকনাফ এলাকায় অবস্থান করেন রোহিঙ্গাদের তথাকথিত নেতা মুহিবুল্লাহ। পরে গঠন করেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নামক একটি সংগঠন। শুরুতে তার এই সংগঠনে যোগ দেন ১৫ জন রোহিঙ্গা।
সংগঠনের নামে তিনি বাংলাদেশিসহ বিদেশি মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। সফর করেন সৌদি আরব সহ সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
এরপর ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) যুক্ত হওয়ার পর মুহিবুল্লার মূল উত্থান শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা থেকেই মুহিবুল্লাহর সংগঠন এআরএসপিএইচের কদর বেড়ে যায়। ইংরেজিতে দক্ষ মুহিবুল্লাহ বিদেশি ও এনজিওগুলোর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।
যদিও ২০১৮ সালের জুলাইয়ে র্যাব একবার মুহিবুল্লাহকে আটক করে উখিয়া থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু প্রশাসনের নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারে যত বিদেশি প্রতিনিধি গেছেন তাদের সবার সঙ্গেই দেখা করেছেন এই মুহিবুল্লাহ। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ১৭ দেশের যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৭ প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করেন সেখানেও যোগ দেন মুহিবুল্লাহ। ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাত করতে সে দেশে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তখন বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়।
এছাড়াও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার রোহিঙ্গারা ২০১৯ সালে দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে উখিয়ার কুতুপালং এক্সটেনশন-৪ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মহাসমাবেশ করে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার প্রস্তুতিতে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন মুহিবুল্লাহ ও তার সংগঠন।