অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সম্প্রতি আলোচনায় আসা ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাশপের বাইরে আরও ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- আলেশা মার্ট, আদিয়ান মার্ট, ফাল্কগ্দুনীশপ, সিরাজগঞ্জশপ, টোয়েন্টিফোর টিকেটি ডটকম, গ্লিটার্স আরএসটি ওয়ার্ল্ড, গ্রীন বাংলা ই-কমার্স লিমিটেড, অ্যানেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেড, আমার বাজার লিমিটেড ও এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড এবং অ্যাগ্রো ফুড অ্যান্ড কনজুমার লিমিটেড।
এসব প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত ছাড় দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করে প্রচুর টাকা নিয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সরবরাহকারীদের কাছ থেকেও বাকিতে পণ্য সংগ্রহ করেছে। কিন্তু তাদের অনেকের কাছে ক্রেতা ও সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ করার মতো পর্যাপ্ত পণ্য বা টাকা নেই। ফলে বিপুল সংখ্যক ক্রেতা ও সরবরাহকারীর পাওনা নিয়ে অনিশ্চয়তার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের ঘটনার পর পুরো ই-কমার্স খাত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা ক্রেতা ও সরবরাহকারীর টাকা নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। ভবিষ্যতে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে মন্ত্রণালয়। ফলে বিপুলসংখ্যক ক্রেতা ও পণ্য সরবরাহকারীর পাওনা অপরিশোধিত থেকে যাবে এবং ভবিষ্যতে আরও প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে।
গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে ডিজিটাল কমার্স ব্যবসায় সাম্প্রতিক সমস্যা বিষয়ে অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কীভাবে এখান থেকে গ্রাহকদের পাওনা পণ্য ও টাকা বের করা যাবে সেজন্য তাদের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ এসেছে সভা থেকে। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য সভায় উপস্থিত পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালককে অনুরোধ করা হয়েছে তাদেরকে নজরদারিতে রাখার।
সভা-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ধামাকাশপের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আলেশা মার্ট এখনও তাদের কার্ডসহ কিছু প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। আরও যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একই ধরনের ব্যবসা করছে সেগুলোকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আলেশা মার্ট, আদিয়ান মার্ট, ফালগুনীশপ ও সিরাজগঞ্জশপের ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে । বাকিদের বেলায়ও একই ধরনের অনুরোধ জানানো হবে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কেউ লেনদেন করলে পণ্য সরবরাহের আগে যাতে টাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাকাউন্টে জমা না হয়, সে বিষয়ে পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। এসব কোম্পানি পণ্য সরবরাহ হয়েছে বলে দাবি করলে সেই দাবি যাচাই-বাছাই করে টাকা ছাড় করতে বলা হয়েছে। এছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং প্রতিযোগিতা কমিশনকে এসব প্রতিষ্ঠানে মনিটরিং জোরদারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ই-ক্যাবকে এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাশপের কাছে দেশের কয়েক লাখ লাখ ক্রেতা ও পণ্য সরবরাহকারী প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাবে। এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের থেকে আগাম টাকা নিলেও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করেনি। আবার যাদের থেকে বাকিতে পণ্য নিয়েছে তাদের টাকা দেয়নি। এক পর্যায়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ইভ্যালিতে তদন্ত চালায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, ক্রেতা ও সরবরাহকারীদের কাছে ৪১৩ কোটি টাকা দায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু তাদের চলতি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬৫ কোটি টাকা। যদিও ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল নিজে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে যে হিসাব দিয়েছেন তাতে বলেছেন, তার কোম্পানির দেনার পরিমাণ ৫৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রেতারা ৩১১ কোটি, সরবরাহকারীরা ২০৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীর দেনা ২৬ কোটি টাকা। ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা পাওনার দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ করলে এর মালিকানায় সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালান। এই কোম্পানির কাছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা পাওনা গ্রাহকদের। ধামাকাশপের কাছে গ্রাহকদের ৮৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠান তিনটি এখন বন্ধ বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।