বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনে যুগ্ম-মহাসচিব ও সম্পাদকদের বৈঠকে আলোচনাজুড়ে ছিল বিভিন্ন সাংগঠনিক বিষয়। বেশির ভাগ নেতাই সারা দেশে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছেন। দল পুনর্গঠন, জোটের রাজনীতি, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলাসহ বিভিন্ন ইস্যু আলোচনায় উঠে আসে।
এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে এক দফা আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলেও মতামত দেন বৈঠকে উপস্থিত নেতারা।
গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গতকাল বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৪টায় শুরু হয়ে বৈঠক প্রায় রাত ১২টায় শেষ হয়। দীর্ঘ এই বৈঠকে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদক ও সহসম্পাদক পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য দেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, নেতারা আশঙ্কা করছেন—আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আবারও একতরফা নির্বাচন করার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। এ অবস্থায় নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে একদিকে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে, অন্যদিকে সরকার পতনের আন্দোলনে জোরালো করতে হবে।
আজ বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠকে যোগ দেবেন। এরপর দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হবে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গেও বৈঠকের সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। সবার মতামতের পর চূড়ান্ত করা হবে আন্দোলনের কৌশল।
বৈঠকে নেতারা তাদের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, যারা গত নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগ নিজ নিজ আসন বাদ দিয়ে থাকেন গুলশান, বনানী থাকেন। ফলে তাদের নিজ নিজ এলাকার রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। যারা বড় বড় কথা বলেন, তারা আন্দোলনে কেউ নামেন না। নেতাদের বেশির ভাগই আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। অনেক নেতা বিএনপির অতীত কার্যক্রম পর্যালোচনা করে নতুনভাবে পথচলার পরামর্শ দিয়েছেন। অনেকে নিজ এলাকার কমিটি গঠনে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছেন।
বৈঠকে বিএনপির বেশির ভাগ নেতা আন্দোলনে যাওয়ার যৌক্তিকতার পাশাপাশি দল ও সংগঠনের নানান অসঙ্গতি তুলে ধরেন। বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন বছরের পর বছর মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, সারাদেশে সাংগঠনিক ইউনিট কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায়াও ধীরগতিতে চলছে। এভাবে দলকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয় বলে নেতারা জানান। অনেক নেতা কমিটি গঠনে অনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়েও অভিযোগ করেন।
এর মধ্যে একজন যুগ্ম মহাসচিব তার বক্তব্যে বলেন, ‘নব্বইয়ের গণভ্যুত্থান নিয়ে অনেকে কথা বলেন। কিন্তু, ওই সময়ের প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আবার ওই সময়ের আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালনকারী ছাত্রনেতা আর এখনকার ছাত্রনেতাদের পার্থক্যও অনেক। তখন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ভবিষ্যতে এমপি হওয়ার জন্য রাজপথে আন্দোলন করেননি। এখনকার একজন থানা পর্যায়ের ছাত্রনেতাও এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। গণিমতের মাল ভাগাভাগির এই আদর্শ ত্যাগ না করলে আন্দোলন সফল হবে না। সবাইকে দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, খালেদা জিয়ার জন্য আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।’
এ সময়ে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিকের দেওয়া চিঠি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, ‘বিএনপির উচিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা।’
বিএনপি নেতা জি কে গউছ বলেন, ‘অঙ্গসংগঠনের কমিটি গঠনে ঢাকা থেকে নেতারা এলাকায় গিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন, পদ প্রত্যাশীদেরকে বিভিন্ন উপঢৌকন নিয়ে সেখানে যেতে হয়। না দিলে ওইসব নেতারা অসন্তুষ্ট হন। আবার এলাকার নেতাদেরকে ঢাকায় ডেকে এনে দিনের পর দিন রাখা হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের যারা খুশি করতে পারেন, তাদেরই নেতৃত্বে আনা হয়।’
বৈঠকে নেতারা ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে শর্তহীনভাবে অংশ নেওয়া এবং সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সংসদে যোগদানের বিষয়ে তারেক রহমানের কাছে জানতে চান। বৈঠকের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য উপস্থিত দু’জন সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করে চলে যান বলে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় জলবায়ুবিষয়ক সহ-সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল বলেন, ‘আন্দোলনের বিকল্প নেই। সেজন্য দল এবং সংগঠনকে গোছাতে হবে। দল এবং অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে সর্বশক্তি ও সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে নামতে হবে। এককভাবে অথবা যেসব রাজনৈতিক দল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়, ভোটের অধিকার চায় তাদেরসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষদের নিয়ে এক প্ল্যাটফর্মে অথবা যুগপৎভাবে আন্দোলনে নামতে হবে।’
মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল বলেন, ‘বিগত দিনে যে যে পর্যায়ে ব্যর্থতা এসেছে, সেসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য দায়ী সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যেসব সংসদ সদস্য, নেতা আন্দোলন-সংগ্রামে শামিল হননি, স্থানীয় নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নেননি তাদের প্রয়োজনে অব্যাহতি দেওয়া যায় কিনা, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
দলের মধ্য সারির নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘রাজনীতিতে যার যা কাজ, তা তিনি সম্পাদন করলে যে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব। নেতারা যে বক্তব্য দিলেন, তা যদি তাঁরা নিজে ধারণ করেন তাহলে দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিশ্চয়ই সফল হবে। তাই নিজের বক্তব্য বাস্তবায়ন করতে হবে।’
রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে শতাধিক নেতা অংশ নেন। এর আগে গত মঙ্গলবার দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হয় ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে। বৈঠকের পরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকের বৈঠকে খালেদা জিয়ার মুক্তি, আগামী নির্বাচন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার তৃতীয় বৈঠক হবে। আগামী শনিবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্বাহী কমিটির সভা ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যসংখ্যা ৫০২ জন। আজ বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে তিন দিনের এ ধারাবাহিক বৈঠক শেষ হবে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে এটি তারেক রহমানের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।