মিয়ানমারে সৃষ্ট সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্তমান সরকারের উদারতা ও মহানুভবতার আশ্রয়ে ৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। শুধু তাই নয় রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টার পাশাপাশি নাগরিকত্ব আদায় করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য সরকার কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু সেই রোহিঙ্গারা শিবিরগুলোতে জড়িয়ে পড়েছে ভয়ঙ্কর অপরাধে। তবে সাধারণ রোহিঙ্গা এসব কর্মকাণ্ডে নাখোশ হলেও ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না।
এই চার বছরে ১২ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে ১২৯৮টি মামলার বিপরীতে ৩ হাজার রোহিঙ্গা আসামি হন। সব মিলিয়ে কক্সবাজার জেলাবাসীর কাছে এখন মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গারা।
জানা গেছে, মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও আগুনে পুড়ানোসহ নানান সহিংসতার অভিযোগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে পালিয়ে পানির স্রোতের মতো এদেশে প্রবেশ করে রোহিঙ্গারা। তখন থেকে কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফে ৩৪ শিবিরে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রিত হয়ে থাকার ৪ বছর পূর্ণ হয়েছে।
এদিকে যতদিন গড়াচ্ছে ততই ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। খুন, অপহরণ, মাদক, ডাকাতি, অস্ত্রসহ ১২ ধরনের অপরাধের অভিযোগে প্রতিদিন কোনো না কোনো শিবির থেকে আটক হচ্ছেন তারা। নিজেরা নিজেদের ভয়ঙ্কর অপরাধ করার পাশাপাশি স্থানীয়দেরকে খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি করেই যাচ্ছেন হিংস্র রোহিঙ্গারা।
অধিকাংশ শিবির ঘুরে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের নৈরাজ্যে শিবিরগুলো দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করেও বিভিন্ন কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কঠিন হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে ৮, ১৪ ও ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) কাজ করছে। এছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবসহ অন্য সংস্থাও কাজ করে যাচ্ছে। তারপরেও খুন, গুম অপহরণ, মাদক ইত্যাদি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা রোহিঙ্গাদের জন্য।
সর্বশেষ গত ১৪ আগস্ট ভোর রাত সাড়ে ৩টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ভাড়াটিয়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বাড়ি ভেঙে স্বামী মোহাম্মদ আলীকে না পেয়ে স্ত্রী মোহসেনা আক্তার নামের গৃহবধূকে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়েছে। এ গৃহবধূর ৪০ দিনের কন্যাসহ দুই কন্যা সন্তান রয়েছে।
৩০ জুন রাতে হোয়াইক্যং শামলাপুর সড়ক হয়ে ফেরার পথে অপহরণ করে স্থানীয় মাহমুদুল করিম ও মিজানুর রহমানকে। দুইদিন পরে মিজান মুক্তিপণ দিয়ে ফিরলেও মাহমুদল করিমের কাছে ১ লাখ টাকা দাবি করে বসে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। পর্যায়ক্রমে বিকাশে ৫৫ হাজার টাকা দিতে পারলেও বাকি টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে যোগাযোগ বন্ধ হলে ১ মাস ১২ দিন পরে পাহাড়ে তার অর্ধগলিত মৃতদেহ পাওয়া যায়।
এছাড়া খুন হন টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, ২০১৮ সালে হোয়াইক্যং উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি আব্দুল রশিদ, ২০১৯ সালে হ্নীলার জাদিমুড়া এলাকার যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক। ২০২০ সালে অপহরণের পর মুক্তিপণের জন্য জবাই করে খুন করে হন হোয়াইক্যং ইউনিয়নের মিনা বাজারের মো. হোছনের ছেলে মো. সাঈদ (২৮), মৌলভী আবুল কাসেমের ছেলে আক্তার উল্লাহ (২৬)। কাটাখালী এলাকার আবুল মনজুরের ছেলে মো. রশিদকে (২৫) হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এছাড়া স্থানীয়দের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় লাগাতার চলছেই।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, গত ৪ বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১২৯৮টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়েছেন ২ হাজার ৮৫০ জন রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে আছে- অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচার ইত্যাদি। এর মধ্যে ৭০টি খুন, ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতি এবং ৩৪টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা ও অন্যান্য আইনে ৮৯টি মামলা উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি আর আসামি হন ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি আর আসামি হন ৬৪৯ জন।
শুধুমাত্র গত এক বছর দুই মাসে (২০২০ জুন থেকে ২০২১ সালের জুলাই) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৫৬৭টি। এর মধ্যে অস্ত্র মামলা হয়েছে ২৯টি, মাদক মামলা হয়েছে ৩৬২টি, ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার মামলা ৩০টি, অপহরণ মামলা ১৮টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা ৭টি, পুলিশ আক্রমণ সংক্রান্ত মামলা একটি, হত্যা মামলা ১৯টি, চোরাচালান মামলা ৫টি, চুরি মামলা ৮ ও অন্যান্য মামরা ৮৯। এসব মামলায় দেড় হাজারের বেশি আসামি হয়েছে।
২৬ নম্বর রোহিঙ্গা শিবির নেতা (মাঝি) বজরুল ইসলাম ও ষাটোর্ধ্ব সৈয়দ আহমেদ জানান, পুরোনোর সঙ্গে নতুন কিছু রোহিঙ্গা মিলে শিবিরগুলো নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। এসব রোহিঙ্গাদের কারণে রাতে পালাক্রমে পাহারা বসানো হয়। কিছুদিন শিবিরে ডাকাতদল ঢুকে পড়লে নারী পুরুষ একসঙ্গে তাদের প্রতিহত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সাধারণ রোহিঙ্গার পাশে থাকার দাবি জানান তারা।
উপকূল বাহারছড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন জানান, রোহিঙ্গাদের মহড়াদের জন্য মানুষ চলাচল করতে পারছে না। তাদেরকে কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘শুরুতেই রোহিঙ্গা ডাকাত অপহরণ তিনিই শুরু করেন। সম্প্রতি রোহিঙ্গারা আবার বেপরোয়া হয়ে পাহাড়ে অবস্থান করছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সবার ঐক্যবদ্ধতার বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, পাহাড়ে বসেই রোহিঙ্গারা এসব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। নিয়ম না মেনে খুন খারাবি অপহরণ অব্যাহত রাখে। আমরা ইতি মধ্যে অভিযান পরিচালনা করে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিদিন খবর আসে রোহিঙ্গারা আইন বিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা ইতিমধ্যে সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ভেতরে যারা মাদক, অস্ত্র খুন, অপহরণসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করছে তাদের বিরুদ্ধে তিনটি ব্যাটালিয়ন কাজ করছে। এছাড়া আরো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। প্রতিদিন অভিযানের অংশ হিসেবে কোনো না কোনো শিবির থেকে রোহিঙ্গা অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে। এ অভিযান আরো কঠোর থেকে কঠোরতম হবে বলেও জানান তিনি।