বরিশালে প্রতিমন্ত্রী-মেয়র দ্বন্দ্ব

2096
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

সপ্তাহ ধরে চলা উত্তপ্ত বরিশাল শহরে অবশেষে বিস্ফোরণ হলো। ধূমপানের ঘটনা কেন্দ্র করে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের বাসার গেটে লাথি মারার ঘটনা ঘটে। এর কয়েকদিনের মাথায় ব্যানার-পোস্টার অপসারণ নিয়ে তুলকালাম ঘটনা ঘটে বরিশাল সিটিতে। বরিশাল সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসায় হামলা, গুলিবর্ষণ ও নেতাকর্মীদের বিক্ষোভে বুধবার রাতভর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। এ সবের জেরে লঞ্চ-গাড়ি বন্ধ থাকায় বৃহস্পতিবার কার্যত অর্ধদিবস অচল ছিল দক্ষিণাঞ্চল। দিন শেষে পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বরিশাল সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। জানা গেছে, এ সবের পেছনে রয়েছে দলীয় কোন্দল। বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম ও সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লার মধ্যকার শীতল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবার প্রকাশ্য রূপ নেয়। সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলায়ই সিটি করপোরেশনের মেয়রকে আসামি করা হয়েছে। এসব ঘটনায় শহরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শহরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

জানা গেছে, বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০ থেকে ২৫ জন কর্মচারী নগরীর সিঅ্যান্ডবি রোডে উপজেলা পরিষদ এলাকায় গিয়ে সদর আসনের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর ছবিসহ বিভিন্ন ব্যানার, বিলবোর্ড অপসারণের কাজ শুরু করে। এ সময় ইউএনওর
কার্যালয় ও সরকারি বাসভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরা তাদের পরিচয় জানতে চান। এ সময় তারা সকালে এসে কাজ করার জন্য বলেন। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের সঙ্গে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের বাগবিতন্ডা হয়। খবর পেয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ বাবুর নেতৃত্বে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত, আতিকুল্লাহ মুনিম, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব খানসহ শতাধিক নেতাকর্মী সেখানে যান। পরে সেখানে আনসার সদস্যদের সঙ্গে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। তখন নেতাকর্মীরা ইউএনওর বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।

হামলার পর ইউএনও মুনিবুর রহমান জানান, উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে শোক দিবস উপলক্ষে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব) জাহিদ ফারুকের ব্যানার-পোস্টার লাগানো ছিল। রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসব ছিঁড়তে আসে। রাতে লোকজন ঘুমাচ্ছে জানিয়ে তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বৃহস্পতিবার সকালে এগুলো ছিঁড়তে বলেন। এর পর তারা তাকে গালিগালাজ করতে থাকে। একপর্যায়ে তারা ইউএনওর বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। রাত সাড়ে ১০টা এবং ১১টায় দুই দফায় তারা হামলা চালায় বলে জানান ইউএনও মুনিবুর রহমান।

এ বিষয়ে কথা বলতে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি। তার ঘনিষ্ঠজনখ্যাত বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, মেয়র বলেছেন আমার ব্যানার আগে অপসারণ করবে। এর পরও যে ঘটনা ঘটেছে এটা অনাকাক্সিক্ষত। মেয়র মহোদয় বরিশাল শান্ত ও সুশৃঙ্খল রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বিগত তিন বছরে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। এখন যা ঘটছে তাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, একটি শান্ত শহরকে অশান্ত করতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ইউএনওর বাসায় কেউ হামলা করেনি। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা। আমরা মনে করি, শোকের মাসে এটি একটি মানবতাবিরোধী কাজ। আমরা এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।

এদিকে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবর রহমানের সরকারি বাসভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলাতেই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। তার নির্দেশে হামলার ঘটনা ঘটে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বুধবার রাতে বাসভবনে হামলার ঘটনায় বৃহস্পতিবার ইউএনও মুনিবুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ২৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭০ থেকে ৮০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানার উপপরির্দশক (এসআই) মো. জামাল বাদী হয়ে পৃথক আরেকটি মামলা দায়ের করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, বরিশালে ইউএনওর সরকারি বাসভবনে যারা হামলা করেছে, তাদের কেউ ছাড় পাবে না। তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে সেখানে কার ভূমিকা কী ছিল।

এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বুধবার রাতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। ইউএনওর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে সৃষ্ট বিরোধের জেরে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণসহ দূরপাল্লার সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ ছিল। শহরের রুপাতলী বাস টার্মিনাল ও নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে সব ধরনের দূরপাল্লার ও আন্তঃজেলা বাসচলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। নগরীর নথুল্লাবাদ ও রুপাতলী বাস টার্মিনালের সামনের মহাসড়কে বাসআড়া-আড়ি রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া বরিশাল সিটি করপোরেশনের আবর্জনা পরিবহনের গাড়ি দিয়ে সদর উপজেলা সংলগ্ন প্রায় এক কিলোমিটার বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। এতে ওই সড়ক দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। সাত ঘণ্টা পর গাড়ি চলাচল স্বাভাবিকের কথা জানিয়েছেন বরিশাল-পটুয়াখালী বাস মালিক সমিতির সভাপতি ও মহানগর যুবলীগের সদস্য মমিন উদ্দিন কালু।
বরিশাল নদীবন্দরে থাকা লঞ্চের শ্রমিকরা জানান, স্থানীয়ভাবে লঞ্চ না চালাতে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল। এ কারণে সকাল ৬টার পর থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। তবে কার নির্দেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য তারা দিতে রাজি হননি। বরিশাল বন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বুধবার রাতে সদর উপজেলারইউএনও এবং বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জের ধরে লঞ্চ মালিকরা সকাল থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছিল। দুপুরের পর লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে জানিয়েছেন বন্দর কর্মকর্তা।

এদিকে গতকাল বেলা ১১টার দিকে নগরের কালীবাড়ি সড়কে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বাড়ির সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য অবস্থান নেন। এ সময় মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ বাড়িতে ছিলেন। সেখানে ছিলেন জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা। তবে সেখান থেকে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ সদস্যরা চলে গেলেও র‌্যাবের একটি দল সেখানে অবস্থান করছিল। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস মেয়রের বাড়িতে যেতে চাইলেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত অভিযোগ করে বলেন, ইউএনওর নির্দেশে আনসার সদস্যরা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। এতে অন্তত ৩০ জন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ নগরীর অবৈধ ব্যানার-বিলবোর্ড অপসারণ চলছিল। বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিসিসি কর্মীরা উপজেলা পরিষদ চত্বরের বিলবোর্ড অপসারণ করতে গেলে তাদের বাধা দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। একপর্যায়ে তিনি বিসিসি কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং সরকারি কাজে বাধা দেন। এ নিয়ে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে আনসার সদস্যরা আমাদের কর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন।

বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, গভীর রাতে ইউএনও বাসভবনে হামলা ও গুলির ঘটনা খতিয়ে দেখা হবে। তদন্তে যে বা যারা দোষী হবেন তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে উদ্ভূত পরিস্থিতি তাৎক্ষণিক মোকাবিলা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশের বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আটক করা হয়েছে কয়েকজনকে।

জানা গেছে, ওই ঘটনায় মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহামুদ বাবু ও রুপাতলী বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আহম্মেদ শাহারিয়ার বাবুসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এদিকে শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বর্ডার ১০ প্লাটুন গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, এর মধ্যে ১০ প্লাটুন বিজিবির সদস্য বরিশালের পথে রয়েছে। রাতে তারা বরিশালে পৌঁছবে। বিজিবির সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকবেন ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন