জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যায় দ-প্রাপ্ত পলাতক পাঁচ খুনির মধ্যে দুজনকে ফেরানোর ওপর জোর দিয়েছে সরকার। কারণ অন্য তিনজন কোথায় আছে তা নিয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকরের ১১ বছর পর সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এএম রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর ব্যাপারে আশাবাদী। তাকে ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্রে স্কাডেন এলএলপি নামে একটি আইনি পরামর্শক সংস্থাকে নিয়োগ করেছে সরকার। অন্যদিকে কানাডা থেকে খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরানোর উদ্যোগে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে সে দেশের আদালতের এক রায়ে। তাকে ফেরানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের এক আবেদনে সাড়া দিয়েছেন কানাডার আদালত।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। পলাতক অবস্থায় বিদেশে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি পাঁচজন পলাতক।
এদিকে দীর্ঘ ৪৬ বছর পর বঙ্গবন্ধুর চার খুনির মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিল করেছে সরকার। গত ৬ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে খুনি নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন খানের খেতাব বাতিল করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার জটিল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে দুই খুনিকে দেশে ফেরাতে দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে বাকি তিন খুনির বিভিন্ন দেশে অবস্থান পরিবর্তনের তথ্য পাওয়া গেলেও এ মুহূর্তে তারা কোন দেশে আছে, তার স্পষ্ট কোনো বার্তা পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেন, প্রাথমিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যেসব দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা পলাতক আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে আমাদের মিশনগুলো সক্রিয় রয়েছে। মিশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেসব দেশের নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। ড. মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে প্রচেষ্ট চালাচ্ছে। তারা যাতে খুনিদের ফেরত দেয়, সে জন্য জনমত তৈরি করতে দেশ দুটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি কমিউনিটিকে আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যেসব দেশে লুকিয়ে আছে বলে সন্দেহ করা হয়, সেসব দেশের বাংলাদেশ মিশনের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও নজর রাখার আহ্বান জানান তিনি।
সূত্র জানায়, রাশেদ চৌধুরী ব্রাজিল থেকে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। ২০০৪ সালে দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় মেলে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে তাকে ফেরত দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অনুরোধ করে। এ প্রক্রিয়া গত বছরের জুনে নাটকীয় মোড় নেয়। যুক্তরাষ্ট্রে ওই খুনির রাজনৈতিক আশ্রয়ের একটি মামলা দীর্ঘ ১৫ বছর বন্ধ থাকার পর দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল তা আবার চালু করেন। ফলে রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এই মামলার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে অনেক অমীমাংসিত আইনি বিষয়ও সমাধান হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন। দেশে ফিরে মোমেন জানান, সফরে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সঙ্গে আলাপ করেছেন তিনি।
খুনি নূর চৌধুরীর বর্তমান অবস্থান কানাডায়। ১৯৯৬ সালে প্রথম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হয়। তাকে ফেরানোর উদ্যোগে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে কানাডার আদালতের এক রায়ে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে চিঠি দিয়ে জানতে চায় নূর চৌধুরীর ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’-এর আবেদন কোন পর্যায়ে আছে; কিন্তু কানাডার আইনে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কাউকে প্রত্যর্পণে বাধা থাকায় দেশটির সরকার জনস্বার্থ রক্ষার যুক্তি দিয়ে নূর চৌধুরী সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ফলে গত বছরের জুনে জুডিশিয়াল রিভিউয়ের আবেদন করে বাংলাদেশ। এ আবেদনে সাড়া দিয়ে নূর চৌধুরীর অবস্থানসংক্রান্ত তথ্যের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আদেশ দেন দেশটির আদালত। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডার ফেডারেল কোর্টের বিচারকের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য দেশটির অটোয়া প্রশাসন আবেদন করে।
এর মধ্য দিয়ে কানাডার অটোয়া আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হেরে গেছে। রায়ে বিচারক বলেন, নূর চৌধুরীর অভিবাসনসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে জনস্বার্থের ব্যাঘাত ঘটবে না। সুতরাং নূর চৌধুরীর বিষয়ে বাংলাদেশকে তথ্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত কানাডা সরকারকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তবে এ বিষয়ে কানাডার সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
পালিয়ে থাকা অন্য তিন খুনির মধ্যে কয়েক বছর আগে খন্দকার আবদুর রশিদকে কখনো স্পেনে, শরিফুল হক ডালিমকে কখনো পাকিস্তানে ও মোসলেম উদ্দিনকে জার্মানিতে দেখা যাওয়ার বিষয়ে অসমর্থিত সূত্রে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তবে ওই তিন দেশ থেকে বাংলাদেশ মিশন জানায়, ওই খুনিরা সেখানে অবস্থান করছে না। ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের আগ পর্যন্ত রশিদ নিয়মিতভাবেই লিবিয়ায় অবস্থান করত বলে বিভিন্ন সময় খবর বেরিয়েছে।
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে এনে আদালতের রায় কার্যকর করার ব্যাপারে শেখ হাসিনার সরকার বদ্ধপরিকর। শুধু তার সরকার নয়, আওয়ামী লীগ যতদিন বাংলাদেশে থাকবে, বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের একজন বেঁচে থাকলেও হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতের রায় কার্যকর করা হবে। তিনি আরও বলেন, খুনিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে বিশদ কিছু বলতে গেলে এ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের কোনো শিথিলতা নেই। খুনি মোসলেম উদ্দিন ভারতে পলাতক রয়েছে এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা তা যাচাই-বাছাই করে দেখেছি। এখন পর্যন্ত কোনো সত্যতা পাইনি।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ১৫ জনকে মৃত্যুদ-াদেশ দেন। আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদ- নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদ-াদেশ বহাল থাকে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। রায় কার্যকরের আগেই ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মৃত্যু হয় আজিজ পাশার। আর গত বছরের ১১ এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিটে আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এই খুনি দীর্ঘদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় পালিয়ে ছিল।