আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের অন্যতম সহযোগী হাজেরা খাতুন এবং সানাউল্ল্যাহ নূরীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তাদের নিয়েই হেলেনা গড়ে তোলেন তার অবৈধ ‘জয়যাত্রা’ টেলিভিশন। আজ মঙ্গলবার বিকেলে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উয়িং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
কমান্ডার মঈন জানান, র্যাবের অভিযানে গত ২৯ জুলাই রাজধানীর গুলশান-২ নম্বর থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের সম্মানহানি করার অপচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে তার প্রতারণার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে দুজন হাজেরা খাতুন (৪০) ও সানাউল্ল্যাহ নূরী (৪৭)।
আজ মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪-এর অভিযানে তারা গ্রেপ্তার হন। তাদের কাছ থেকে দুটি ল্যাপটপ এবং দুটি মুঠোফোন জব্দ করা হয়। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে র্যাব।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার হাজেরা খাতুন ২০০৯ সালে কুমিল্লার একটি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেন। এরপর তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন মিরপুরে একটি গার্মেন্টস অ্যাডমিন (এইচআর) পদে চাকরি শুরু করেন। তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীরের কাছে আত্মীয় এবং নিজের কর্মদক্ষতায় তার অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।
২০১৬ সালে তিনি ‘জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন’র ডিজিএম হিসেবে নিযুক্তি পান। এরপর তিনি ‘জয়যাত্রা টিভি’ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জিএম (অ্যাডমিন) পদে নিযুক্ত হন। তিনি মূলত দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ হেলেনা জাহাঙ্গীরের আর্থিক বিষয় দেখভাল করতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
জয়যাত্রা টিভি সম্পর্কে গ্রেপ্তার হাজেরা খাতুনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, জয়যাত্রা টিভি ২০১৮ সাল থেকে হংকংয়ের একটি ডাউন লিংক চ্যানেল হিসেবে সম্প্রচার হয়ে আসছে। এর ফ্রিকুয়েন্সি হংকং থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে। ওই ফ্রিকুয়েন্সির জন্য হংকংকে প্রতি মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়। হংকং থেকে বরাদ্দ ফ্রিকুয়েন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচারের কোনো বৈধ অনুমোদন নেই বলে জানান হাজেরা।
সম্প্রচারের জন্য ক্যাবল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রিসিভার জয়যাত্রা টিভি বা তার প্রতিনিধির দ্বারা ক্যাবল ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। প্রতিনিধিরা ক্যাবল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সম্প্রচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে চাকরিচ্যুত হয়ে থাকেন।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব আরও জানায়, এই টিভি বাংলাদেশের প্রায় ৫০টি জেলায় সম্প্রচারিত হয়ে থাকে। টিভি চ্যানেলটি রাজধানী ও জেলা পর্যায়ের পাশাপাশি মফস্বল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে ব্যাপক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অধিকসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা যায়। গুরুত্ব বিবেচনায় জেলা প্রতিনিধিকে ৩০ থেকে ৫০০ হাজার টাকা, উপজেলা প্রতিনিধিকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা এককালীন প্রদান করতে হয়। এ ছাড়া প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রতি মাসে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
ওই টিভি বিশ্বের প্রায় ৩৪টি দেশে সম্প্রচারিত হয়। যেখানে দেশের গুরুত্ব বিবেচনায় এক থেকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রতিনিধিরা নিয়োগ পেয়ে থাকেন। যারা প্রতি মাসে বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রদান করে থাকেন। নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ সংগ্রহ ও যাবতীয় হিসাবপত্র গ্রেপ্তার হাজেরা খাতুনের ওপর ন্যাস্ত বলে তিনি জানান।
হাজেরা খাতুনের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়েছেন। হেলেনা জাহাঙ্গীরের পরিকল্পনা, উৎসাহে বা চাপে, নির্দেশনায় জয়যাত্রা টিভির কোনো কোনো প্রতিনিধি নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন। এ ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যক্তি প্রচার, প্রার্থিতা প্রচার, সাক্ষাৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি অংশ গ্রেপ্তারকৃতদের মাধ্যমে হেলেনা জাহাঙ্গীর গ্রহণ করে থাকতেন বলে তারা জানান।
যে সমস্ত বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমে প্রচারিত হতো না সেগুলো জয়যাত্রা টিভিতে প্রচার করা হতো। যেমন : তাবিজ-কবোজ, টুটকা-ফাটকা, ভাগ্য বলে দিতে পারে, জ্বীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, ফাঁড়া কেটে যাওয়া এবং গোপন সমস্যার সমাধান ইত্যাদি।
জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন সম্পর্কে হাজেরা খাতুন আরও জানান, ফাউন্ডেশনে ডোনার, জেনারেল মেম্বার, লাইফ টাইম মেম্বার ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এই সংগঠনের প্রায় ২০০ জন সদস্য রয়েছে। তাদের কাছ থেকে সদস্য পদ বাবদ ২০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এর কিছু অংশ মানবিক কাজে ব্যবহার করে জয়যাত্রা টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হতো। অবশিষ্ট অর্থ তার সন্তানদের নামে সঞ্চয় করা হতো।
গ্রেপ্তারকৃত সানাউল্ল্যা নূরী সম্পর্কে র্যাব জানায়, তিনি জয়যাত্রা টিভির প্রতিনিধি সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীরের নির্দেশনায় প্রতিনিধিদের সমন্বয় সাধন করতেন। প্রতিনিধিদের কেউ মাসিক টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বা গড়িমসি করলে তিনি ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতেন। এলাকায় তার নামে চাঁদাবাজি অভিযোগ রয়েছে। তিনি গাজীপুর গার্মেন্টস সেক্টরে ব্যাপক চাঁদাবাজি করে তার একটি অংশও জয়যাত্রা টিভিতে প্রদান করতেন বলে জানান। এ ছাড়া তিনি গাজীপুর ও তদসংলগ্ন এলাকার অনুমোদনহীন জয়যাত্রা টিভির সম্প্রচার নিশ্চিত করতেন।