নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ গ্রুপের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আজ শনিবারও কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কারখানার পাঁচ ও ছয় তলার কিছু কিছু অংশে এখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে এবং অল্প-বিস্তর আগুন জ্বলছে।
এদিকে, এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫২ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাতে তিন জন মারা যান এবং গতকাল শুক্রবার ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। আজ শনিবারও চলছে উদ্ধার কার্যক্রম। তবে নতুন করে কোনো মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ছয় তলা ভবনের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। ফ্লোরের ভেতরে প্রবেশপথ গুলো সরু ও বাঁকা। কোনো কোনো প্রবেশপথে নেট দেওয়া থাকায় শ্রমিকেরা বের হতে পারেননি। সবচেয়ে বেশি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে চার তলা থেকে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঢাকার সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের উদ্ধারকাজ ও অগ্নিনির্বাপণ একসঙ্গে চলছে। সমন্বিতভাবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভেতরে তেমন আগুন নেই। কিছু জায়গায় হালকা ধোয়া হচ্ছে। এই ধোয়া বন্ধ করার চেষ্টা করছি। আশা করি, সহসাই আমরা এটি পারব। তবে পরে আর কোনো মরদেহ আমরা পাইনি। পাঁচ ও ছয় তলায় কোনো মরদেহ পাওয়া যায়নি। সারা রাত কয়েক দফায় আমরা কাজ করেছি, আরও উদ্ধারকাজ চালাব।’
সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, ‘আশা করি আজ শনিবার বিকেলের মধ্যে উদ্ধার কার্যক্রম শেষ হবে। তবে এসব উদ্ধারকাজের শেষ বলতে কিছু নেই। হয়তো পরে দেখা যাবে অন্য কোথাও দুর্ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট না হব, উদ্ধারকাজ চলবে।’
অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা জানান, কী কারণে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। তদন্ত কমিটি আজ থেকে কাজ শুরু করবে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ওই কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুন লাগার পর পরই গোটা ভবনে লেলিহান শিখা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে।
গতাকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ৫২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ঢামেক মর্গে লাশগুলো নিয়ে আসার পর থেকে সেখানে বাড়তে থাকে স্বজনদের উপস্থিতি। স্বজনদের উপস্থিতি আর তাদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে মর্গের বাতাস। মর্গে স্বজনেরা ছবি নিয়ে এসে আকুতি জানাচ্ছে প্রিয়জনের লাশটি ফিরে পেতে। কিন্তু, লাশগুলোকে চেনা যাচ্ছে না অতিরিক্ত পুড়ে যাওয়ার কারণে। ফলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নিহতদের স্বজনদের কাছ থেকে ডিএনএ-এর নমুনা সংগ্রহ করা শুরু করেছে। ঢামেক মর্গে আসা স্বজনদের কাছ থেকে এ নমুনা নেওয়া হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্বজনদের কাছে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে জানাচ্ছেন সিআইডির ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাবের সদস্যরা।
ফরেনসিক ল্যাবের সহকারী অ্যানালিস্ট আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমরা ঢামেক মর্গে আসা স্বজনদের কাছ থেকে নমুনা নিচ্ছি। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হবে। নমুনা পরীক্ষার পর লাশ চিহ্নিত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’
ফায়ার সার্ভিস থেকে জানানো হয়েছিল, ছয়তলা ভবনজুড়ে বিভিন্ন কাঁচামাল থাকায় আগুন ভয়াবহ হয়ে উঠে। সেই লেলিহান শিখা দ্রুতই কারখানার দুটি ইমারজেন্সি গেট (জরুরি বা বিকল্প বহির্গমন পথ) পর্যন্ত প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আর এর ফলে শ্রমিকেরা যেমন কারখানার উপরতলা বা নীচতলায় উঠতে-নামতে পারেনি। ঠিক তেমনি ইমারজেন্সি গেট ব্যবহার করে বেরও হতে পারেনি। অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকেই ধোঁয়া আর অগ্নিকাণ্ডে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা ফায়ার সার্ভিসের।
সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি
কারখানায় এই অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এ কমিটিকে আগামী সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম বেপারীকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি চাইলে আরও লোক নিতে পারবে। যদি তাঁরা মনে করেন, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের লোক নেবেন, নিতে পারবেন।’
নিহতের পরিবার পাবে দুই লাখ টাকা
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে শ্রম কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে দুই লাখ টাকা এবং আহত শ্রমিকদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান।