সংসদ প্রতিবেদক
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পদত্যাগের দাবি উঠেছে সংসদে। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা শনিবার পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ‘নির্লজ্জ’ আখ্যায়িত করে এ দাবি তোলেন। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তুলোধুনো করে বিরোধী দলের সদস্যরা বক্তব্য দেওয়ার সময় মন্ত্রী জাহিদ মালেক অধিবেশন কক্ষে ছিলেন না।
বগুড়া-৬ আসনের বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মুহম্মদ সিরাজ আলোচনার সূত্রপাত করে বলেন, বগুড়া এখন করোনার হটস্পট। গত তিনদিনে সেখানে ২৪ জন মারা গেছেন। সেখানে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সংকট। সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। জেলার তিনটি কোভিড হাসপাতালে করোনা রোগীতে ঠাসা। তিনি বগুড়ায় ২০টি করে হাই ফ্লো নেইজাল ক্যানুলা সরবরাহ এবং সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের দাবি জানান।
গত ৩০ জুন সংসদে বাজেট পাসের সময় বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জেলা হাসপাতালের সভাপতি সংসদ সদস্যরা উল্লেখ করে ওই দিন আইনপ্রণেতাদের ওপর দায় চাপান মন্ত্রী। জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজী স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘সেদিন সংসদে আমি সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা নিয়ে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম চার টাকার মাস্ক ৩৫৬ টাকায় কেন কেনা হল। উনি তদন্ত করবেন, দেখবেন, ব্যবস্থা নেবেন। এই হল মন্ত্রীর দায়িত্ব। কিন্তুু তিনি সেটা এড়িয়ে বললো, এটা সত্য না। আমি তথ্য-প্রমাণ নিয়ে এসেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। দুদকে চলে গেছে। পত্রিকায় এসেছে। ওনাদের একটি প্রকল্পের পিডি স্বীকার করেছে। উনি বলেছেন, উনি ওইসময় ছিলেন না। উনি কী করবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এড়িয়ে না গিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতেন। ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘করোনা অত্যন্ত মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। সব জায়গায় সেনাবাহিনী নামিয়ে এটা প্রতিরোধ করতে হবে। পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, একটা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত আমাদের সামনে আসল না। মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু এইভাবে চিকিৎসা দিতে গিয়ে এই ধরনের অনিয়ম মানা যায় না। জিজ্ঞেস করলেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সব দিচ্ছি। কিন্তু কোথাও কিছু নেই। এভাবে আমরা একটা বছর সময় নষ্ট করেছি। আমাদের সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব দিলে, অর্থ দিলে আমরা সবকিছু ঠিক করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। দায়িত্বে যারা আছেন, তারা তো দু’দিন পরে চলে যান। জবাবদিহিতাতো তাদের নেই। ফিরোজ রশীদ বলেন, আইসিইউ বেড আছে। কিন্তু প্রশিক্ষিত ডাক্তার-নার্স নেই। অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন। বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু কোনো তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত আমাদের সামনে আসেনি। মানুষের জীবনের কি কোনো দাম নেই? করোনা তো এখন সারা বিশ্বেই রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসায় কী এ ধরনের অনিয়ম মানা যায়। তিনি বলেন, সাতক্ষীরায় অক্সিজেনের অভাবে সাতজন কোভিড রোগী এক ঘণ্টার মধ্যে ছটফট করতে করতে মারা গেছেন। আগের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হকের বাড়ি সেখানে। সেখানকার হাসপাতালটি ফাইভ স্টার মানের হওয়া উচিত ছিল। মন্ত্রী যান, মন্ত্রী আসেন। কিন্তু নিজের এলাকাটাও ঠিক রাখতে পারেন না।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, এক বছরে নাকি অনেক কাজ করেছেন। আজকের খবর আসছে, বাংলাদেশের ৩৭টি জেলায় অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে পাঁচজন রোগী অক্সিজেন পায় তো ২০ জন লাইনে থাকে। কেবল অক্সিজেনের কারণে তারা ছটফট করে মারা যাচ্ছেন। পত্রিকায় এত লেখালেখি হচ্ছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী একটি হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে এগুলো দেখেছেন। তিনি তা না করে জুম মিটিং করেন। চুন্নু বলেন, কোভিড চিকিৎসার সময় নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন উল্লেখ করে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে একটি কিস করার কারণে তাকে রিজাইন দিতে হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি মানুষ! বুঝলাম না। উনার লজ্জা-শরম কিছু নেই। চরিত্র নেই। উনার রিজাইন দেয়া উচিত।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘উনি বলেছেন, আপনারা তো হাসপাতালের চেয়ার। মেশিন চলে না, লোক লাগবে এগুলো তো আপনাদের দেখতে হবে। কিন্তু আপনারা তো দেখেন না। নার্স, ডাক্তার যন্ত্রপাতি লাগলে আপনাদের বলতে হবে। অভিযোগ দিলে তো হবে না। এগুলোর ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু আপনাদের বলতে হবে। চেয়ারম্যান হিসেবে এগুলো দেখার দায়িত্ব আপনাদের ওপর বর্তায়। উনার বক্তব্যে মনে হচ্ছে, কোনো এমপিই দায়িত্ব পালন করেন না। অথচ আমি হাসপাতালের চিকিৎসকসহ লোকবল নিয়োগের জন্য উনার দফতরে গিয়েছি। এ বক্তব্য আপত্তিজনক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী গোটা হাউসকে অপমান করেছেন। তার বক্তব্য এক্সপাঞ্জ হওয়া দরকার।’ করোনা পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ উল্লেখ করে হারুন বলেন, যেকোনো মূল্যে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেভাবে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তিনি বলেন, ক্ষুধা দারিদ্র্যের কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। সামনে ঈদুল আজহা। এ জন্য গরিব মানুষের জন্য দ্রুত খাদ্য দেয়ার দাবি জানান তিনি। কোরবানির পশু পরিবহন ও কেনাবেচায় শিগগিরই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে। না হলে এটা নিয়েও সংকট তৈরি হবে।