টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এক যুগ হলো সরকার পরিচালনা করে আসছে দলটি। এর মধ্যেই দলের ভেতরে বিভিন্ন বলয় গড়ে ওঠার কথা শোনা গেছে মাঝে মাঝে। তৃণমূলেও রয়েছে নেতৃত্বের লড়াইয়ের একাধিক দল-উপদল। এর মধ্যে সরকার পরিচালনায় আবার আওয়ামী লীগ নেতাদের বদলে অন্য একটি শ্রেণির প্রভাব বেশি— এমন কথা বলে থাকেন কেউ কেউ। এ নিয়ে দলের ভেতরে রয়েছে আলোচনা-সমালোচনা, ক্ষোভ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কখনো কখনো এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, দল ও সরকারের মধ্যে কোনো ধরনের দূরত্ব বা সমন্বয়নহীনতা নেই।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সরকার ও দলের মধ্যে সমন্বয় আছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এই দুই সত্তাকে সমন্বয় করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। তবে সরকারের সঙ্গে দলের মধ্যেকার সম্পর্কে তার কোনো প্রভাব নেই।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কারও কারও অভিযোগ, মাঠ প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পর্ক খুব একটা সুখকর নয়। অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে সরকারকে বিব্রত হতে হয়। আর ক্ষমতাসীন হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিতে হয় তার দায়ভার। কোথাও কোথাও স্থানীয় আওয়ামী লীগের অবস্থান দুর্বল রাখতে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে গ্রুপিং জিইয়ে রাখতেও সরকারি কর্মকর্তারা ভূমিকা রেখে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি ফুল গাছের পাতা খাওয়ার অভিযোগে ছাগল আটকে মালিকের অনুপস্থিতিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করা, নসিমনচালককে আটকে রাখা, জরুরি নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা চাওয়া বৃদ্ধকে যাচাই-বাছাই না করেই বড় অঙ্কের জরিমানা করা— এমন বেশকিছু ঘটনায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করলে এসব ঘটনা সহজেই এড়ানো সম্ভব হতো।
এদিকে, সম্প্রতি ‘লকডাউন’ চলার সময় রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ম্যাজিস্ট্রেট, চিকিৎসক ও পুলিশের বাহাস ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের হেনস্তার শিকার হওয়ার ও পরবর্তী সময়ে নথি চুরির অভিযোগে মামলা দায়েরের ঘটনা দেশ তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল আলোচিত। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নানের ফেব্রুয়ারি মাসে কিশোরগঞ্জে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এসব ঘটনা সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট হলেও ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে দায় নিতে হচ্ছে। সমালোচনার পুরোটাই আসছে আওয়ামী লীগের ওপর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের কয়েকজন নেতা বলেন, আমাদের দল টানা মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু বিশেষ কিছু শ্রেণির মানুষের প্রভাবের কারণে মনে হয় আমরাই বিরোধী দলে আছি। তারা স্থানীয় এমপি ও তার বলয়ের কয়েকজন নেতা ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দিতে চান না। আমরা রাজনীতি করি, আমাদের কাছে মানুষ বিভিন্ন কারণে আসে। কিন্তু কোনো কাজ নিয়ে গেলেই নানা অজুহাতে নানারকম কথা বলে আমাদের অসহযোগিতা করা হয়।
কেন্দ্রীয় নেতারা অবশ্য সরকার তথা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও দলের মধ্যেকার সম্পর্কে কোনো ধরনের বিরোধ বা দূরত্বের আভাস দেখতে পাচ্ছেন না। তারা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তারা যা করছেন, তার সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।
তারা আরও বলছেন, প্রশাসনিক ইউনিটে মন্ত্রণালয়ের প্রধান কিন্তু একজন মন্ত্রী, যিনি আমাদের দলের একজন নেতা। আবার সেই মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মগুলো করছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। এখন তাদের মধ্যে কোনো সমস্যা থাকলে তো মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম মুখ থুবড়ে পড়ত। একইভাবে মাঠ প্রশাসনেও সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কের ভিত্তিতে অনেক কাজই পরিচালিত হয়। সেখানেও সমন্বয়হীনতা থাকলে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ব্যাহত হতো, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ত সাধারণ জনগণের ওপর।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, সরকার ও দলের ভেতরে সমন্বয়ের সমস্যা নেই। তার মূল কারণ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। অর্থ্যাৎ দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রধান— দু’জন একই ব্যক্তি। ফলে সরকার ও দলের মধ্যে সমন্বয় আছে। প্রধানমন্ত্রী দলে সভাপতি হিসেবে যেভাবে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখেন, আমরাও অনেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও সেই রকম খোঁজখবর রাখি কি না, সন্দেহ আছে। একইভাবে সরকারের কোথায় কী হচ্ছে বা না হচ্ছে, তার সব খোঁজখবরও তিনি রাখেন। আমরা মনে করি, দল ও সরকারের সফল সমন্বয়ের মাধ্যমেই তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এ সংক্রান্ত অভিযোরে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এস এম কামাল বলেন, ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে ব্যক্তি বিশেষের সম্পর্ক ভালো নাও হতে পারে। কিন্তু যার দিকনির্দেশনায় দল চলে, সেই প্রধানমন্ত্রী শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দলের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখেন। কোথাও কোনো সংকট থাকলে আমরা তার কাছে নির্দেশনা চাই, তিনি আমাদের পথ দেখান। সমাধান দেন।
সরকার ও দলে সমন্বয়হীনতা দেখছেন না আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানও। তিনি বলেন, আমার কাছে এরকম কিছুই মনে হচ্ছে না। কারণ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের সমন্বয়হীনতা বা দূরত্ব থাকলে সেটি অবশ্যই চোখে পড়ত। সেক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যাও দেখা দিত। তেমন কিছু দেখছি বলে মনে হচ্ছে না। এমন কিছু আমাদের নজরে নেই।
তিনি বলেন, এর আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক গতিশীলভাবে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দক্ষ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে যেমন সাংগঠনকিভাবে শক্তিশালী রেখে পরিচালনা করছেন, তেমনি জনগণের সব ধরনের প্রয়োজন, আপদ-বিপদ মাথায় রেখে তিনি সরকারও পরিচালনা করছেন। প্রশাসনের কোথায় কী প্রয়োজন, সেগুলোও তার নজর এড়ায় না। তিনি একই ব্যক্তি হিসেবে যেখানে দুইটি সত্তাকেই একজন নিজে সমন্বয় করছেন, সেখানে সমন্বয়হীনতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।