ঢাকা থেকে গত সাত দিনে ২৫ থেকে ২৮ লাখ মুঠোফোন ব্যবহারকারী অন্য জেলায় গেছেন। এ হিসাব গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এবার ঢাকা ছাড়া মুঠোফোন গ্রাহকের সংখ্যাটি গত বছর করোনা ঠেকাতে দেওয়া সাধারণ ছুটির সময়কার তুলনায় বেশ কম।
দেশের একটি মোবাইল অপারেটর তাদের তথ্যভান্ডার ও কল প্রবণতা বিশ্লেষণ করে এ হিসাব জানিয়েছে। সংখ্যাটি ‘ইউনিক ইউজার’ ধরে। এর মানে হলো, এক ব্যক্তির একাধিক সিম থাকলেও তাঁকে একজন গ্রাহক হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে।
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত বছর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ১ কোটি ১০ লাখ মুঠোফোন ব্যবহারকারী ঢাকা ছেড়েছিলেন বলে ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। এ সংখ্যা ইউনিক ইউজারের কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এবারের ২৮ লাখের হিসাবটি সাত দিনের। এ হিসাবের আওতায় মুঠোফোন ব্যবহারকারী নয় এমন মানুষ ও শিশুরা আসেনি। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মোবাইল অপারেটরটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এবার দেখা যাচ্ছে গত বছরের তুলনায় কমসংখ্যক গ্রাহক ঢাকা ছেড়েছেন। তথ্য বিশ্লেষণ করে বিষয়টি বোঝা যায়।
এদিকে গত কয়েক দিনের মতো গতকালও গ্রামমুখী মানুষ সড়কে ও ঘাটে ভিড় করেছেন। তাঁরা জেলার অভ্যন্তরীণ রুটের বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলে করে দূরের পথে রওনা দেন। তবে চাপ আগের তিন দিনের তুলনায় কিছুটা কম ছিল।
কয়েক দিন ধরে মানুষের ব্যাপক ভোগান্তির পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়ার দুই ফেরিঘাটে ফেরি চালানো বাড়িয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে গতকাল সন্ধ্যা থেকে বাড়তি সংখ্যায় ফেরি চালানো শুরু হয়। এতে মানুষের ভোগান্তি কমে।
বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় প্বলেন, ঘাটে চাপ বুঝে ফেরির সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় কত মানুষ বাস করে, তার হালনাগাদ কোনো পরিসংখ্যান নেই। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিসাবে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। এ জনসংখ্যার একটি বড় অংশ পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় গ্রামে যায়।
অবশ্য করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ৫ মে জারি করা বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কর্মস্থল ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দূরপাল্লার বাস চলছে না। এর মধ্যেও কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ ভেঙে ভেঙে দূরের পথে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গী চরম দুর্ভোগ। পাশাপাশি ব্যয়ও দ্বিগুণ। আর স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা হচ্ছে না।
বেশির ভাগ সীমিত আয়ের মানুষ
যাঁরা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সীমিত আয়ের মানুষ। একটি অংশ কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকেন, পরিবার থাকে গ্রামে। তাঁদের একজন আসাদুজ্জামান কর্মস্থল থেকে ছুটি পেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় বরিশালের উদ্দেশে মাইক্রোবাসে চড়েন। তিনি জানান, মাইক্রোবাসটি সরাসরি বরিশাল যাবে। একেকজনের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে এ পথে বাস ভাড়া ৪৫০ টাকা। ঈদে তা ৫৫০ টাকা দিতে হয়।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গতকাল ঝিনাইদহের মহেশপুরে রওনা হয়েছিলেন রিকশাচালক আশরাফুল ইসলাম। পাটুরিয়া ঘাটে আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর কন্যাসন্তানকে নিয়ে তিনি হুড়মুড়িয়ে ফেরিতে উঠতে পারলেও তাঁর স্ত্রী পারেননি। দৌলতদিয়ায় আশরাফুল বলেন, আরেকজনের মুঠোফোন চেয়ে স্ত্রী তাঁকে কল করেছিলেন।
শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার ঘাটে নেমে বেশ খুশি খুলনাগামী যুবক ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘করোনার মধ্যে ভিড় ঠেলে বাড়ি যাইতে ভয় তো একটু করেই। কিন্তু কী আর করার। বাড়িতে আমার মুখ চেয়ে স্ত্রী, ছোট বাচ্চারা দুই দিন ধরে অপেক্ষা করতাছে।’
ঢাকার ডেমরার একটি হোসিয়ারি কারখানার শ্রমিক ইয়াসমিন আরা (২৭) তাঁর ছোট বোন জেসমিন আরাকে (২৩) নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড়ে অপেক্ষা করছিলেন। ফেনীর দাগনভূঞায় মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে যাচ্ছেন তাঁরা। করোনার ঝুঁকি সত্ত্বেও ঈদে বাড়ি যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে জেসমিন বলেন, ‘লকডাউন দিছে, খাবার কি দিছে? খাই না-খাই, নিজের বিপদ নিজেই সামলাইছি। এহন কিছু হইলেও ওই বিপদ আমাগোরই সামলাইতে হইব।’
এই দুই বোন পথে ঝামেলা হলে নেমে যাওয়ার শর্তে জনপ্রতি ৮০০ টাকা ভাড়ায় ফেনীগামী একটি মাইক্রোবাসে চড়ে বসেন। সাধারণ সময়ে বাসে ভাড়া লাগে ৪০০ টাকার মতো।
তিন গুণ যানবাহন পারাপার
মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস না চললেও অন্যান্য যানবাহন অনেক বেড়েছে। কতটা বেড়েছে, তার একটা ধারণা পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপারের হিসাব দিয়ে। সেতুর টোল প্লাজা সূত্র জানায়, গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সেতু দিয়ে ৩১ হাজার ৮৯৯টি যানবাহন পারাপার হয়। স্বাভাবিক সময়ে ২৪ ঘণ্টায় ১২ থেকে ১৩ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এদিকে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে গতকাল ভোরে সেতু এলাকায় প্রায় ৫ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে দুপুরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
শুধু উত্তর বা দক্ষিণবঙ্গ নয়, গতকালও মানুষ ছুটেছে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন রুটে। সবার সঙ্গী দুর্ভোগ ও চড়া ভাড়া। স্বাস্থ্যবিধি মানানোর চেষ্টা কোথাও দেখা যায়নি।
‘আগেই পরিকল্পনা করা যেত’
রাজধানী ও আশপাশের বেশির ভাগ পোশাক কারখানায় আজ মঙ্গলবার কাজ শেষে ছুটি হবে। ফলে আজ দুপুরের পর থেকে সড়কে চাপ তৈরি হতে পারে। গতকাল কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভের পর অধিকাংশ পোশাক কারখানাই ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত ছুটি দেওয়ার কথা জানিয়েছে। যদিও সরকারি নির্দেশ ছিল, তিন দিনের বেশি ছুটি দেওয়া যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ গত রোববার রাতে বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ঝুঁকি মাথায় নিয়েও কিছু মানুষ গ্রামে যাবে। এক পোশাকশ্রমিক দম্পতি, যাঁদের সন্তান গ্রামে থাকে, তাঁদের বাড়ি যাওয়া আর অন্য মানুষের বাড়ি যাওয়া এক কথা নয়। তিনি বলেন, কারা করোনার মধ্যেও গ্রামে যায়, তাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি কী—এসব বিশ্লেষণ করে বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা করা যেত। না যাওয়ার জন্য প্রচার চালানো, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া ও অন্যান্য কার্যক্রম নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তারপরও যাঁরা যাবেন, তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচলের একটা ব্যবস্থা করা যেত।