খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা: আইনি দিক খতিয়ে দেখছে বিএনপি

1801
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

আইনগতভাবেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন বলে মনে করে বিএনপি। এ জন্য আইনগত দিক খতিয়ে দেখার ওপর জোর দিচ্ছে দলটি। পাশাপাশি স্বাধীনতার পর দ-প্রাপ্ত হয়েও বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন- এ রকম নজিরও খুঁজছে দলটি।

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের আবেদন গত রবিবার নাকচ হওয়ার পর দলটি এ উদ্যোগ নিয়েছে। এই নিয়ে আজ মঙ্গলবার দলের পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করবেন। গত রবিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা ও দ-াদেশ স্থগিত করে যেভাবে তাকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তাতে এখন আর তাকে বিদেশে যেতে দেওয়ার সুযোগ নেই।

আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১ (১) ধারা অনুযায়ী কোন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা কোনো শর্ত ছাড়া অথবা শর্তসাপেক্ষে সরকার স্থগিত করতে পারে। এ ধারা অনুযায়ী আরও কিছু শর্ত পরিবর্তনও করতে পারে। সে অনুযায়ী যে কোনো স্থানে দেশে অথবা বিদেশে এই শর্ত জুড়ে দিয়ে সাজা স্থগিত বা স্থগিতের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারে। আরোপিত শর্ত পরিবর্তনের ক্ষমতা সরকারের নেই বা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে না- এটা আইনের সঠিক ব্যাখ্যা বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয় না। সরকার অবশ্য খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদন প্রত্যাখ্যান বা নামঞ্জুর করতে পারত। কিন্তু শর্ত পরিবর্তন করা যাবে না- এটা আইনের ভুল ব্যাখ্যা।

সিসিইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসায় সরকারের অনুমতি না দেওয়াকে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এটা যতটা না আইনি, তার চেয়ে রাজনৈতিক বেশি। দ-প্রাপ্ত আসামি বিদেশ যেতে পারবে না বলে সরকারের দিক থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে- তা সঠিক নয়। তাহলে সাজাপ্রাপ্ত আসামি আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম কীভাবে ২০০৮ সালে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েছিলেন?

তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে সাজাপ্রাপ্ত হয়েও বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন- এ রকম বহু নজির রয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশে গণমাধ্যমেরও খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া তার স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বলে চিকিৎসকরা বলেছেন। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের মা খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি না দেওয়া যতটা সরকারের আইনি সিদ্ধান্ত, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ, জনবিচ্ছিন্ন এই সরকার খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাকে ভয় পায় এটা আবার প্রমাণ হলো।

বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, সরকারের মনোভাবে প্রথমে মনে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেবে। পরিবারের সদস্যরাও আশাবাদী ছিলেন। দেশের মানুষও সরকারের মনোভাবকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছিল। কিন্তু হঠাৎ সরকারের সিদ্ধান্তে বিএনপিসহ দেশের মানুষও হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ছাত্রদল নেত্রী মানসুরা আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি করেছেন। ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব আমানউল্লাহ আমান বলেন, এই কর্মসূচিতে ছাত্রলীগ বাধা দিয়েছে। এতে প্রমাণ করল প্রতিবাদ করার ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারে তাদের বিশ্বাস নেই। এ ঘটনা ছাত্রলীগের পৈশাচিক চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ।’

এ দিকে, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতে বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্মদিন নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা। ওই নেতা বলেন, করোনা আক্রান্ত খালেদা জিয়া তৃতীয় নমুনা টেস্টে নেগেটিভ আসে। সেই সনদের অর্জিনাল কপিতে তার জন্মদিন ১৫ আগস্ট থাকলেও তা জাল করে ৮ মে করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়। যাচাই বাছাই না করে কোনো কোনো মিডিয়া কথিত সেই সূত্র ধরে গতকাল সংবাদও পরিবেশন করেছে।

গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই প্রতিবেদন নিয়ে কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, অবশেষে করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে খালেদা জিয়ার আসল জন্মদিন জানা গেল। এই প্রতিবেদন অনুসারে প্রকৃত অর্থে তার জন্মদিন ৮ মে।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার যে রিপোর্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা সরকারের লোকজনের মুখে ছড়িয়েছে সেটা মূলত ভুয়া। এই রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এর সত্যতা মিলত বলেও তিনি জানান। এই নিয়ে বিএনপির কয়েক নেতার কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, জনদৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতে আওয়ামী লীগ এসব করছে।

বিএনপি সরকারের পাতা ফাঁদে পা দেবে না। কীভাবে খালেদা জিয়া বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেন সেই লক্ষ্যে আছেন। এজন্য তারা আইনজীবীদের সাথেও কথা বলছেন। এই নিয়ে বিএনপি তার নিজস্ব ফেসবুক পেজে সঠিক চিত্র তুলে বলেছেন, খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্ট, সেই অনুযায়ী করোনা টেস্টের রেজাল্ট এসেছে।

এ দিকে, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিএনপি ও তার জোট নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়া আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি না দেওয়ার বিষয়কে যতটা আইনি দিক রয়েছে, তার চেয়ে সরকার রাজনীতি বেশি করেছে।

দলের নেতারা মনে করেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের বছরে খালেদা জিয়াকে ভিত্তিহীন মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দি করার অর্থ হচ্ছে তাকে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া। যে ষড়যন্ত্র ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকে হয়ে আসছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ার পরও জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে ১৯৭৯ সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মান পাঠানো হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মানবিক বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল সবার আগে। বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটি আমি আশা করেছিলাম। কিন্তু গত রবিবার সরকারের পক্ষ থেকে যা করা হয়েছে তাতে আমি বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন।’

খালেদা জিয়াকে কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক উল্লেখ করে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তটি অবশ্যই অমানবিক ও নিবর্তনমূলক। আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য মানবিক আহ্বান জানাচ্ছি। আদালতের মাধ্যমে জামিনবঞ্চিত বেগম জিয়াকে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে জেলের বাইরে, নিজ বাড়িতে সুযোগ দিয়েছে সরকার। এজন্য সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। একই পদ্ধতিতে সরকার, আইনি জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিতে পারতেন বা এখনো পারবেন। আমরা সেই আবেদনই করছি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব) ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম ও মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. রেদোয়ান আহমেদ যৌথ বিবৃতিতে বলেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসা না দিয়ে তার ওপর সরকার অন্যায়-অবিচার করেছে। মানবতার দিক দিয়ে হলেও খালেদা জিয়াকে জামিন দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়া উচিত। তাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান নেতারা।

উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তাফা জামাল হায়দার ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আহসান হাবীব লিংকন। তারা বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন। বর্তমান সরকার তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তারা তাকে বিদেশে উন্নত ও সুচিকিৎসার সুযোগ দিচ্ছে না। অথচ মানবতার কাছে আইন কোনো বিষয় নয়। আমরা বিশ্বাস করি সরকার মানবিক দিক বিবেচনা করে খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিবে। তা না হলে উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় সরকারকেই বহন করতে হবে।

এলডিপির একাংশের মহাসচিব শাহাদত হোসেন বলেন, কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অতীতেও এরূপ মানবিকতার নজির সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।

বিবৃতিতে অসুস্থ খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা প্রশ্নে সরকারের সিদ্ধান্তের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও মহাসচিব লায়ন ফারুক রহমান বলেছেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত অমানবিক ও ধৃষ্টতাপূর্ণ।

এছাড়াও খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন (জেডআরএফ)। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার বলেন, খালেদা জিয়া শুধু বিএনপির চেয়ারপারসন নন; তিনি বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সরকার মহামারী করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বিষয়টি মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে তাকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে পারত। গুরুতর অসুস্থ হলেও তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়াটা সত্যিই বেদনাদায়ক, অমানবিক ও নজিরবিহীন।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন