অনেক হাসপাতালেই শয্যা খালি নেই। রোগীর স্বজনেরা ছুটছেন এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে। গুরুতর অসুস্থ যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন, তাঁদের অনেককেই আবার পড়তে হচ্ছে অক্সিজেন-সংকটে। হাসপাতালগুলোয় এসব সংকট প্রতিদিনই প্রকটতর হচ্ছে। সর্বোপরি বলা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। দিনরাত চিতা জ্বলছে শ্মশানগুলোয়। সব মিলিয়ে ক্রমেই বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কেন্দ্র হয়ে উঠছে ভারত।
ভারতে গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি করোনার সংক্রমণের প্রথম ঢেউ চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। তখনো রোগী শনাক্তের সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ গড় ছিল ৯৩ হাজারের আশপাশে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত শনিবার থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ, যা যেকোনো দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্তের নতুন রেকর্ড।
গতকাল সকাল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, ভারতে করোনায় সংক্রমিত মোট রোগী শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি। অর্থাৎ উপসর্গহীন, মৃদু, মাঝারি ও গুরুতর অসুস্থ—সব মিলিয়ে ভারতে গতকাল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন করোনা রোগী ছিলেন প্রায় ২৯ লাখ। অথচ তিন দিন আগেও, গত বৃহস্পতিবার চিকিৎসাধীন করোনা রোগী ছিলেন প্রায় ২৩ লাখ। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, ভারতে করোনা পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
রোগী বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত শনিবার থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৭৬৭ জনের। এ নিয়ে ভারতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখের কাছাকাছি হলো।
পরিস্থিতি ক্রমেই শোচনীয় হচ্ছে
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এর করা ভবিষ্যদ্বাণীকে এরই মধ্যে পেছনে ফেলেছে করোনা মহামারি। ল্যানসেট বলেছিল, ভারতে করোনায় দৈনিক মৃত্যু আগামী জুন মাসের গোড়ার দিকে ২ হাজার ৩০০ ছাড়াবে। গত শনিবার ২২ এপ্রিলই সে সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভারতে আক্রান্তের সাপ্তাহিক গড় ছিল খুবই কম, ১১ হাজারের আশপাশে। সবার মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, ভারত হয়তো করোনামুক্ত হতে চলেছে। কিন্তু তা যে হয়নি, ভেতরে-ভেতরে টের পাওয়া যাচ্ছিল। যেমনটা টের পেয়েছিলেন মহারাষ্ট্র রাজ্যের মুম্বাইয়ের সাংবাদিক দিলনাজ বোগা।
দিলনাজ বলেন, ‘বাবার অসুস্থতার জন্য গত কয়েক মাসে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম, হাসপাতালগুলোয় বেডের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। নার্সরা বললেন, তাঁরা করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি লক্ষ করছেন। অথচ সবাই তখন ভাবছিলেন, কোভিড বুঝি চলেই গেছে। সংবাদমাধ্যমেও কোনো লেখালেখি হচ্ছিল না।’
দিলনাজের অভিজ্ঞতার এক মাসের মধ্যে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মহারাষ্ট্রের অবস্থা সাংঘাতিক। ভারতের প্রায় ২৩ লাখ করোনা রোগীর ৩০ শতাংশই মহারাষ্ট্রের। সেখানে গত শুক্রবার থেকে শনিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ৬৭ হাজার। মারা গেছেন ৭৭৩ জন।
শুধু মহারাষ্ট্রই নয়, রোগী বাড়ছে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যেও। রাজধানী নয়াদিল্লিসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে অনেক হাসপাতালেই শয্যার পাশাপাশি রয়েছে অক্সিজেন-সংকট। দিল্লিতে সমস্যা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে একটি হাসপাতালে ২০ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে অক্সিজেন-সংকটে।
মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অমিতাভ ব্যানার্জি। সপ্তাহ তিনেক আগে তাঁর মা করোনায় সংক্রমিত হন। তাঁকে ভর্তি করা হয় দক্ষিণ মুম্বাইয়ের কোলাবা অঞ্চলে নৌবাহিনীর হাসপাতাল আইএনএইচএস অশ্বিনীতে। সেই সময় অশ্বিনীর অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যান অমিতাভ। তিনি বলেন, ‘অশ্বিনী দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল, এটি সাধারণের জন্য নয়। যাঁদের পরিবারের সদস্যরা সামরিক বাহিনীতে আছেন বা ছিলেন, তাঁরাই এখানে চিকিৎসা করাতে পারেন। সেখানেই দেখলাম অবিশ্বাস্য অবস্থা। যদি ৩০টি বেড থাকে, তাহলে রোগী ১০০ জন। সেবা দেওয়ার লোক নেই। সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু রাতারাতি স্বাস্থ্যকর্মী তো তৈরি করা যায় না। শোচনীয় অবস্থা। যদি তিন সপ্তাহ আগে অশ্বিনীর এই অবস্থা হয়, তবে একবার ভাবুন এখন কী অবস্থা!’
মুম্বাইয়ের চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিষয়ক একটি সাময়িকী ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিকেল এথিকস-এর সম্পাদক সঞ্জয় নাগরাল মনে করছেন, অবস্থাটা কোথায় পৌঁছাবে বা কত মৃত্যু হবে, তা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।
১৮ এপ্রিল ডা. নাগরাল বলেন, ‘সপ্তাহ দুয়েক আগে মুম্বাইয়ে ১০ থেকে ২০ জন দৈনিক মারা যাচ্ছিলেন। এখন মৃত্যু হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ জনের। এবার যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো কম। দু-তিন সপ্তাহ গেলে বোঝা যাবে আক্রান্ত ও মৃতের অনুপাত কী দাঁড়ায়।’
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মৃত্যুহার ১ দশমিক ৭ শতাংশের নিচে থাকলে তা খুব খারাপ নয়। কিন্তু যদি তা ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার নেবে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই হার ছিল ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। ডা. নাগরাল বলেন, অল্প বয়স্করা, বিশেষত শিশুরা এবার আক্রান্ত হচ্ছে। এটা প্রবল চিন্তার। কারণ, মানুষকে রাখার জায়গা থাকবে না। ডা. নাগরাল এই কথা বলার পাঁচ দিনের মধ্যে মুম্বাইয়ের অনেক হাসপাতালেই তৈরি হয়েছে শয্যাসংকট।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও উঠে আসছে মানুষের আর্তি। কেবলই মৃত্যুসংবাদ সেখানে। দিল্লি, উত্তর প্রদেশ ও মধ্য ভারতের ছত্তিশগড়েও একই অবস্থা। মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরছেন অক্সিজেন, ওষুধ, হাসপাতালের শয্যার জন্য। কলকাতাতেও অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। এক আইনজীবী জানালেন, তিন হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার সেখানে বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজারে। কলকাতার অনেক হাসপাতালেই শয্যা খালি নেই।
অক্সিজেনের জোগানকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা-ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি ও কংগ্রেসের জোট সরকারের সঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপির) সরকারের বিরোধ শুরু হয়েছে। মহারাষ্ট্র বলছে, কেন্দ্র তাদের অক্সিজেনের জোগান নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিজেপি।
চরম আতঙ্কে শ্রমজীবীরা
মুম্বাইসংলগ্ন মীরা-ভয়ন্দর অঞ্চলের বাসিন্দা অমিতাভ বললেন, ‘রোজ সকালে যখন হাঁটতে বেরোই, তখন এই অঞ্চলের সার সার বহুতল ভবনের গেটে একই ধরনের বোর্ড চোখে পড়ে। তাতে লেখা থাকে, এই ভবনে কোভিডে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। এটা এত বেশি সংখ্যায় আগেরবার চোখে পড়েনি।’
না পড়ারই কথা। অতীতের সঙ্গে এবারের সংক্রমণের একটা বড় ফারাক হলো সমাজের নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে আপাতদৃশ্যে সংক্রমণের হার কম। ডা. নাগরাল বললেন, ‘এই পর্যবেক্ষণে হয়তো কিছুটা সত্যতা রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে, যেখানে উচ্চবিত্তরা যান, সেখানে চাপ অনেক বেশি। সরকারি হাসপাতালে রোগী যাচ্ছেন কম। তবে আবারও বলব, কিছুদিন পর আমরা প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারব।’
শনাক্ত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ৩,৪৯,৬৯১ জন মোট শনাক্ত ১,৬৯,৬০,১৭২ জন চিকিৎসাধীন চিকিৎসাধীন করোনা রোগী ২৮,৭৫০,৬২ জন ২২ এপ্রিল চিকিৎসাধীন ছিলেন ২২,৯১,৪২৮ জন ৩ দিনে রোগী বেড়েছে ৫,৮৩,৬৩৪ জন মৃত্যু ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ২,৭৬৭ জন মোট মৃত্যু ১,৯২,৩১১ জন তথ্যসূত্র: ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
২০১১-এর আদমশুমারি মোতাবেক ভারতে যাঁরা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করেন, এমন শ্রমিকের সংখ্যা ৪৫ কোটির আশপাশে। অর্থাৎ জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ। তাঁদের একটা বড় অংশ রয়েছেন শিল্প শহর মুম্বাইয়ে।
মুম্বাইয়ে এমন শ্রমিকের একটা হিসাব দিলেন বিলাল খান, যিনি ‘ঘর বাঁচাও ঘর বানাও’ বলে একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। সংস্থাটি শ্রমিকদের স্থায়ী আবাসনের দাবিতে কাজ করে। তিনি বলেন, ‘মুম্বাইয়ের দুই কোটি মানুষের মোটামুটি অর্ধেক এমন শ্রমিক, বস্তিতে থাকেন। তাঁরা এখন এক বেলা খেয়ে রয়েছেন। জানি না শেষ পর্যন্ত তাঁদের কী হবে।’
দক্ষিণ-পূর্ব মুম্বাইয়ের মান্ডালা-মানখুর্দ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ওমর শেখ চামড়ার ব্যাগ বানাতেন। এখন অবশ্য তাঁর কারখানা বন্ধ। বড় বিপদের ইঙ্গিত দিলেন ওমর শেখ। তিনি বলেন, ‘বস্তির বাসিন্দারা করোনা পরীক্ষা করাতে উৎসাহী নন। যদি আক্রান্ত হন, তবে যেটুকু কাজ আছে, সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। করোনা থেকে সেরে ওঠার পরও কেউ কাজে ডাকবে না, এমন আতঙ্কও রয়েছে। এ ছাড়া বস্তিতে যেহেতু সবাই ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকেন, তাই প্রতিবেশীরাও চলে যেতে বলবেন।’
বিলালের বক্তব্য, ভারতে অসংগঠিত ও ঠিকা শ্রমিকের যে বিরাট সমস্যা, তা পুরোপুরি অনাবৃত করে দিয়েছে মহামারি। তিনি বলেন, ‘এখানে ও গোটা ভারতে ৯০ শতাংশের ওপরে শ্রমিকের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঠিকা শ্রমিক যেদিন কাজে যাবে, সেদিনই টাকা পাবে, না গেলে পাবে না। ১৫ দিন কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) থাকলে রুজি-রোজগার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে, খাবে কী?’
সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ারও তীব্র বিরোধিতা করলেন বিলাল। বললেন, ‘যখন সরকারের হাতে কোনো রাস্তা থাকে না, তখন তারা প্রথমেই লকডাউন দেয়। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র ও অনেক গভীরে। ঠিকা শ্রমিকেরা দৈনিক সরকারি মজুরির সাধারণত এক-তৃতীয়াংশ পান। তাঁদের হাতে কোনো জমানো টাকাই থাকে না। আর গত বছরের লকডাউনের ফলে অনেককেই সংসার চালাতে ধারদেনা করতে হয়েছে। এখন ধার শোধ করতে হচ্ছে। মহারাষ্ট্র সরকার এখন কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ফলে বাঁচার সব রাস্তা বন্ধ।’
মুম্বাইয়ে বেঁচে থাকাটা যে একেবারেই কঠিন হয়ে উঠেছে, তা ফুটে উঠল বিলালের সহকর্মী অখিলেশ রাওয়ের কথায়ও। অখিলেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভাড়া দেওয়ার জন্য তিনটি গাড়ি কিনেছিলেন। ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে গাড়িগুলো সস্তায় বিক্রি করে দিয়েছেন। গাড়ি বিক্রির টাকায় এবং আবার একটি ঋণ নিয়ে ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে তিনি তৈরি পোশাকের একটি কারখানা চালু করেন। এখন সেই কারখানাও বন্ধ। চরম হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কর্মচারীদের বাড়ি চলে যেতে বলেছি। জানি না কী হবে!’
গত বছর যখন সংক্রমণ বেড়েছিল, তখন রাজ্য সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল টাকাপয়সা, খাবারদাবার জোগাড় করে মুম্বাইয়ে এবং সারা ভারতে অবস্থা সামাল দিতে। এবার তা হচ্ছে না। এবার এমন অনীহার কারণ হিসেবে মুম্বাইয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক কর্মী বললেন, অনেকেরই চাকরিবাকরি নেই।
বিদেশি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বলছে, দ্রুত প্রবৃদ্ধির যে গল্প গত দেড় দশকে ভারতে শোনা যাচ্ছিল, তা ইতিহাস হয়ে গেছে করোনা মহামারির কারণে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিইডব্লিউ জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে ভারতে অন্তত ৩ কোটি ২০ লাখ মধ্যবিত্ত ইতিমধ্যে নিম্নবিত্তে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির জ্যেষ্ঠ গবেষক জেনিফার নুজো বলেছেন, ভারত মানবিক বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য দেশের ভারতের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
কেন দারিদ্র্য বাড়ছে, তার একটা উদাহরণ দিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী অখিলেশ রাও।
তিনি বলেন, ‘একজন ঠিকা নির্মাণশ্রমিকের দৈনিক রোজগার মুম্বাইয়ে এক হাজার টাকা। তাঁকে রোজ সকালে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়, যেখান থেকে ঠিকাদারেরা নিয়ে যান। পুলিশ কাউকে রাস্তায় দাঁড়াতে দিচ্ছে না, রোজগার বন্ধ। সরকার খালি ইউরোপ-আমেরিকার লকডাউন দেখায়। ওখানে একটা সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা রয়েছে। এখানে নেই।’
ডা. নাগরাল অবশ্য বললেন, যেভাবে গত বছর পুরোপুরি লকডাউন করা হয়েছিল, তা এখনো মুম্বাইয়ে হয়নি, অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
মুম্বাইয়ে সরকারি খাতায় নথিভুক্ত শ্রমিকদের জন্য সরকারি সাহায্যের একটা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এই শহরে অন্য রাজ্য থেকে আসা শ্রমিকদের অধিকাংশই সেই খাতায় নাম তোলেন না। বিলাল খান বলেন, অনেকেই গ্রামের পরিচয়টাও ছাড়তে চান না। হয়তো ভাবেন, পরিচয়টা ছেড়ে দিলে শহরে উদ্বাস্তু হয়ে যাবেন। এটা দুই ভারতের পরস্পর বিরোধিতার গল্প—একটা ক্রমশ বিত্তবান হওয়া ভারত, অপরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ভারত। এই ফারাকটাকে সামনে এনেছে করোনা মহামারি।
ভারতের নামকরা একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বললেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ না করে গত এক বছরে এই ধ্বংসের গোটা দায়িত্বটা মানুষের ঘাড়ে চাপিয়েছে সরকার। এর মূল্য দিতে হবে।
আর সাংবাদিক দিলনাজ বোগার মতে, করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ জীবিকা বাঁচানোর সঙ্গে জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।