দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়াতে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) সংযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। তাদের গবেষণা বলেছে, মার্চের শেষ সপ্তাহে দেশে করোনাভাইরাসের যে ধরনগুলো সক্রিয় ছিল, তার ৮১ শতাংশই দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট।
এই ভ্যারিয়েন্টে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা নিয়েও সংশয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। তবে বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন কোভিড বিষয়ক কারিগরি কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা যদি দুই ডোজ দেওয়া হয়, তাহলে ৯১ শতাংশ প্রটেকশন হয়, আর ৯ শতাংশ হয় না। এখন সাউথ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১) মিউটেশনগুলো হয়েছে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের (বি.১.১.৭) ৫টা ভ্যারিয়েন্ট কমন। মাত্র দুইটা মিউট্রেশন সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে অতিরিক্ত, তারমধ্যে একটি হলো আগেকার ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তার ১০ শতাংশ সে এভোয়েড করতে পারবে। ফলে ৯১ শতাংশ প্রটেকশন থেকে ৯.১ শতাংশ বাদ যাবে। তাহলে ৮২ শতাংশ কার্যকর হবে।
‘এখন যদি কেউ বলে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টে এ টিকা কার্যকর হবে না, তাহলে বুঝা যাবে এই টিকা একদমই কার্যকর হবে না। সুতরাং কার্যকর হবে না কথাটি বলতে গেলেও ভেবে-চিন্তে বলতে হবে, লিখতে গেলেও সতর্কতার সঙ্গে লিখতে হবে’ –যোগ করেন ডা. নজরুল ইসলাম।
তিনি আরও বলেন, পৃথিবীতে এমন অনেক টিকা আছে, যেগুলোর কার্যকরী ক্ষমতা হলো ৬৫ শতাংশ। আর এটি কার্যকর না হওয়ার পরেও ৮২ শতাংশ কার্যকর হবে। তাহলে কোনটা ভালো? সুতরাং এই বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করে বলতে হবে। আপনি যদি সরাসরি বলে দেন, এই টিকা কার্যকর হবে না, তাহলে তো সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে যাবে, আর টিকা নেবে না।
আইসিডিডিআর,বি বলছে, গত ১৮ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে গবেষকরা ৫৭টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ৪৬টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের উপস্থিতি পেয়েছেন, যা ৮১ শতাংশ। দক্ষিণ আফ্রিকার এই ধরন ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রমণশীল।
এর আগে ১২ থেকে ১৭ মার্চ গবেষকরা ৯৯টি নমুনা পরীক্ষা করেন এবং ৬৪টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন পাওয়ার কথা জানান, যা ৬৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি যে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে যুক্তরাজ্য বা অন্যদের পরিবর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটি সর্বাধিক প্রচলিত রূপে পরিণত হয়েছিল।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং কানাডার সিনিয়র পলিসি বিশ্লেষক ডা. শাহরিয়ার রোজেন বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন এ ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে তেমন কার্যকর নয়। পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি-অর্থাৎ, এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল থেকে জানা গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সৃষ্ট মৃদু ও মাঝারি ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন মাত্র ১০ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টে প্রাপ্ত ‘ই৪৮৪কে’ মিউটেশনের উপস্থিতির কারণে এই নতুন ধরনটির মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়ানোর কৌশল বিদ্যমান। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন মৃদু এবং মাঝারি সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা না দিলেও, গুরুতর সংক্রমণের বিরুদ্ধে কিছুটা সুরক্ষা দেয়। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
শাহরিয়ার রোজেন বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার তাদের জনগণকে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পরিবর্তে দক্ষিণ আফ্রিকা জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছে। আবিষ্কৃত সব ভ্যাকসিনের মধ্যে জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিনটি দক্ষিণ আফ্রিকার এ ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি কার্যকর। গবেষণায় জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের এ ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকায় ৬৪ শতাংশ এবং মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে ৮২ শতাংশ কার্যকরিতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশের কেবল অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভরতা বন্ধ করা এবং জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করা উচিত।
স্বাস্থ্যবিধির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা খুব সীমিত; তাই নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, হাত ধোয়ার অভ্যাস চালু রাখতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের কারণে টিকার কার্যকারিতা নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দিতে কিনা? জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকা শতভাগ কাজ করছে না, কম হচ্ছে।
তিনি বলেন, কোনো কোনো জায়গায় ১০ ভাগ, কোথাও ৪০-৫০ ভাগ কাজ করছে। সেগুলোও দেখার দরকার ছিল। সে জন্য আইসিডিডিআর,বি যদি আইসিইউ রোগীদের দেখত, তারপর অন্য রোগীদের দেখত এবং অ্যান্টিবডির সঙ্গে লিঙ্ক করত, তাহলে ভালো হতো। এটার ইমপ্যাক্ট করোনা নিয়ন্ত্রণ বা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য খুব যে বেশি ভালো হচ্ছে, তা না।