মো. শফিকুল ইসলাম: গতবারের চেয়েও দ্বিতীয় ঢেউেয়ের করোনা ভাইরাস আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে শনাক্ত ও মৃত্যু। বেড ও আইসিইউ সংকট রয়েছে হাসপাতালগুলোতে। তাই উপসর্গহীন ও মৃদু উপসর্গের করোনা রোগীদের বাসাবাড়িতে থেকে চিকিৎসার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। তবে বেশি অসুস্থ রোগীদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অক্সিজন। তাই করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিমিটারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে বাসাবাড়িতে মজুদের হিড়িক বেড়েই চলেছে। ফলে এই করোনা সংকটে অক্সিজেন সিলিন্ডার দাম তো বটেই, হয়ে উঠছে দুষ্প্রাপ্যও। খোলা বাজার ও অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুন বেশি দামে।
চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্তদের একটি বড় অংশেরই প্রয়োজন হচ্ছে অক্সিজেন। কিন্তু চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সরবরাহেও সংকট দেখা দিচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়েও কেউ কেউ সিলিন্ডার মজুদ করছেন। এ অবস্থায় চাহিদার সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
অক্সিজেন সংকটের অভিযোগ করেছেন করোনা আক্রান্ত চিকিৎসাধীন রোগীরাও। হাসপাতালে রোগী রেখে স্বজনদের দৌড়াতে হচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য। এর মধ্যেই ব্যক্তিপর্যায়ে সিলিন্ডার কেনার হিড়িক পড়েছে। অনেকেই পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবেও অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাড়িতে মজুদ করছেন। ফলে বাড়তি চাহিদার সুযোগে দোকান-অনলাইনে নেওয়া হচ্ছে উচ্চমূল্য। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অক্সিজেন প্রস্তুতকারী আন্তর্জাতিক কোম্পানি লিন্ডে বলছে, অক্সিজেনের চাহিদা বর্তমানে এতটাই বেড়েছে যে, তারা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, করোনায় কিছু মানুষ আতঙ্কিত হয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার, পালস্ অক্সিমিটার কেনার জন্য বিভিন্ন মাকের্ট ও সরবরাহ প্রতিষ্টানগুলো ভিড় করছেন। আর এই সুযোগে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সিলিন্ডার বেশি দামে বিক্রি করছেন। জানা গেছে, বেশি মুনাফা লাভের আশায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়াই দেদার বিক্রি হচ্ছে সিলিন্ডার। এমনকি বেচাকেনায় মানা হচ্ছে না বিধিনিষেধ। আগে সিলিন্ডার ভাড়া পাওয়া গেলেও এখন যাচ্ছে না। এক কোম্পানির সিলিন্ডারে ‘রিফিলও’ করছে না অন্য কোম্পানিগুলো। তার বদলে সিলিন্ডার বিক্রি করে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকার ব্যবসায় বেশি মনোযোগ তাদের।
কয়েকজন ক্রেতা বলেন, পরিবারের যে কেউ ভবিষ্যতে করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। কারো অবস্থা সংকটাপন্ন হতে পারে তাই আগেভাগেই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রাখছেন। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য অনেকেই অক্সিজেন সিলিন্ডার না কিনেই বাড়ি ফিরেছেন।
অক্সিজেন সিলিল্ডার কিনতে আসা ধানমন্ডির জামিল আহমেদ বলেন, কয়েকদিন আগে তার বাবা করোনা শনাক্ত হয়েছে। শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। হাসপাতালে আইসিইউ ফাকা নেই। তাছাড়া হাসপাতালগুলোর অবস্থাও খারাপ। তাই রোগী নিয়ে যেতে ভরসা পাইনি। সংক্রমণের ভয়ে তাই বাসায় চিকিৎসা করানো ভালো। কিন্তু সেখানেও অক্সিজেনের সংকট আছে। তাই ঘরেই সিলিন্ডার কিনে এনেছি।
তিনি বলেন, এক মাস আগেও একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ছিলো ১০-১২ হাজার টাকা। আর রিফিল করতে লাগত তিনশ টাকা। কিন্তু এখন সেই সিলিন্ডারের দাম ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। রিফিল এক থেকে তিন হাজার টাকা। একটা সিলিন্ডারের জন্য অনেক বিক্রেতার কাছে ধরনা দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত ২৫ হাজার টাকায় নিয়েছি কিন্তু পছন্দের ব্র্যান্ডেরটি পায়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ছাড়া বাড়িতে অক্সিজেন ব্যবহারে রোগীর ঝুঁকি আরো বাড়তে পারে। এমনকি অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এদিকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো সংক্রমণ বাড়ায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে বিপাকে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে বেসরকারি হাসপাতালেও বেড মিলছে না। করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালগুলোতে প্রতি ঘন্টায় গড়ে ৩ থেকে ৪ চারজন চিকিৎসা নিতে আসছেন। এর মধ্যে গুরুতর রোগীই বেশি। হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের সংকটও তীব্র। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনার ১০টি হাসপাতালের ১০৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ফাকা রয়েছে চারটি। খুব মারাত্মক রোগীর জন্যএসব আইসিইউ ফাঁকা রাখা হয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনার কারণে গত এক বছরে হোম সার্ভিস হিসেবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ডেলিভারির বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তারা কয়েকগুন বেশি দামে বিক্রি করছে প্রতিটি সিলিন্ডার। পাশাপাশি স্বল্প সময়ের জন্য ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে। সিলিন্ডারের পাশাপাশি পোর্টেবল অক্সিজেন ক্যান, পোর্টেবল ভেন্টিলেটর এবং শরীরে অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের জন্য ‘পালস অক্সিমিটার’ও দেদার বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে অনলাইনে দেখা যায়, রাজধানীতে অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম ডেলিভারি দেওয়ার জন্য বেশকিছু অনলাইন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং ফেসবুক পেজ চালু হয়েছে। সিলিন্ডারের পাশাপাশি ১২ লিটারের পোর্টেবল অক্সিজেন বারও বিক্রি হচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার ও পরিমাপের ফলোমিটারের দামও আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে জানা গেছে, অক্সিজেন ব্যবহারের সময় পরিমাপের জন্য ব্যবহূত ফলোমিটারও সংকট হয়ে গেছে। দেড় হাজার টাকার ফলোমিটার এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। সামনে আরো বাড়তে পারে।
অনলাইন ফেসবুক পেজ ‘এমসিএল ভার্চুয়াল হাসপাতালের অ্যাডমিন মাহবুব আলম জানান, গত দুই সপ্তাহে অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এতে দামও কিছুটা বাড়ছে। এক বছর আগে এক হাজার ৫০০ লিটার পরিমাণের সিলিন্ডারের দাম সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা ছিল, সেটা এখন ২৬ হাজার ৫২২ টাকা। এ দাম আরো বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এখনই সিলিন্ডার সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ অনেকে করোনা আতঙ্কে সিলিন্ডার কিনে মজুত করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাড়া দেওয়ারও ব্যবস্থা চালু করেছেন। জরুরি প্রয়োজনে খুব কম সময়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হবে, রোগীর প্রয়োজন শেষ হলে আবার ফেরত নিয়ে আসা হবে। ভাড়া ব্যবস্থা জনপ্রিয় হলে অযথা সিলিন্ডার মজুত করার প্রবণতা কমবে।
গত বছর করোনার প্রকোপ বাড়া শুরু করলে, তখন বাজারে অক্সিজেন সিলিন্ডারে সংকট তৈরি হয়। তবে এবারে সেই শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন দোকানিরা। ‘অক্সিজেন ঢাকা ডট কম’-এর স্বত্বাধিকারী জিয়েম মোল্লা বলেন, এখনো বাজারে সিলিন্ডারের তেমন সংকট নেই। বাজারের পাশাপাশি, অনলাইনেও চাহিদা বাড়ছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের। চব্বিশ ঘন্টা হোম ডেলিভারি, সিলিন্ডার রিফিলের সুবিধা নিচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু যেহেতু চাহিদা বাড়ছে, তাই দামও ঊর্ধ্বমুখী।
তেজগাঁও কলোনী বাজার এলাকার লিনডের পরিবেশক আবু তাহের বলেন, সরবরাহ না থাকায় কয়েকদিন ধরে কোম্পানিটির সিলিন্ডাওে চাহিদা অনেক বেশি। আর সিলিন্ডারগুলো আমদানি করা হয়। চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা যাচ্ছে না। তবে দাম অনেক বেশি।
তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়াই অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারে প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, যাদের প্রয়োজন নাই তারা বাসায় সিলিন্ডার মজুত করছেন। অথচ যাদের প্রয়োজন তারা পাচ্ছেন না। আর রোগীর জন্য অক্সিজেন ব্যবহার কোনো যেকারো কাজ না। এর প্রবাহ নির্ধারণ করতে হয়। কমাতে হয়, বাড়াতে হয়। কতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন তা নির্ধারণ করতে হয়। এটা না করে রোগীকে অক্সিজেন দেয়া বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। চোখ ও শ্বাসতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুনশি বলেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। শ্বাসকষ্ট হলে কখন কীভাবে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হবে, তা অনেকেই জানেন না। প্রয়োজন ছাড়া অক্সিজেন ব্যবহারে শরীরে অন্য সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়া বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত রাখার নির্দিষ্ট নিয়মও রয়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডারের অক্সিজেন শরীরে গেলে অসুস্থতা বাড়তে পারে।
আইইডিসিআর’র উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন জানান, অক্সিমিটার যে কেউ বাড়িতে রাখতে পারেন। তবে প্রয়োজন ছাড়া অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার যৌক্তিকতা নেই।এভাবে অক্সিজেন ব্যবহার শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, এ অক্সিজেন ব্যবহার রোগীর কোনো কাজেই আসে না। রোগীর কতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন সেটা না বুঝে অক্সিজেন দেওয়া হলে তা রোগীর ক্ষতির কারণ হতে পারে।