ধেয়ে বাড়ছে সংক্রমণ, ঝুঁকিতে ২৯ জেলা

1466
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

মো. শফিকুল ইসলাম: ভয়ঙ্কর রপে আকার ধারণ করছে করোনা ভাইরাস। প্রতিদিন আক্রান্তের রেকর্ড ভেঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। এবার আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এরই মধ্যে শনাক্তের হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। রাজধানীতে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের আইসিইউতে কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। একটি আইসিইউর জন্য হাহাকার বেড়েই চলছে। আগে যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিয়ে করোনা রোগীদের সুস্থ করে তোলা হয়েছে তা এখন আর কাজ করছে না। তাই মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রাণঘাতী করোনা ভয়ঙ্কর রূপে আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। সংক্রমণের হার এভাবে বাড়তে থাকলে দ্রুতই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় মানুষের মধ্যে ড্যামকেয়ার ভাব এখনো দেখা যাচ্ছে। মাস্কবিহীন বেপরোয়া চলাফেরায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। স্বজনরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটেও রোগী ভর্তি করতে পারছেন না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের করোনায় আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। অক্সিজেন সিলেন্ডার কিংবা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য আকুতিতে স্বজনের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে হাসপাতালের পরিবেশ।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও রোগতত্ত্ববিদ ড. মোশতাক হোসেন বলেন, এবারের করোনা সংক্রমণ আগেরবারের চেয়ে বা প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে কিছুটা আলাদা। দেশে করোনার প্রথম যে ঢেউ শুরু হয়েছিল, সেই ঢেউ চূড়ায় উঠতে অনেক সময় লেগেছিল। খুব ধীরে ধীরে সংক্রমণের হার উপরে উঠেছিল। অন্যদিকে এবার উঠছে খুব দ্রুত।

তিনি বলেন, ভাইরাসের গতি পরিবর্তন বিষয়ে এখনো কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। তবে সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে ভাইরাস মিউটেটেড হয়ে আরো শক্তিশালী হতে পারে। তৈরি হতে পারে নতুন ধরন। এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে জিনোম সিকোয়েন্সিং বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের দেশে নতুন ধরন তৈরি হচ্ছে কি না বা সেটার শক্তি-সামর্থ্য কেমন।

চার দিন ধরে হালকা জ্বরে ভুগছিলেন বোধ করছিলেন ধানমন্ডির সায়মা সুলতানা (২৮)। সন্দেহ হওয়ায় করোনার নমুনা টেস্ট করেন। পরে মোবাইলে মেসেজ আসে করোনা পজেটিভ। বাড়িতে চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তিন দিন পার হতেই হঠাৎ তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার। জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সায়মাকে। পরের দিনই এমন পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে, চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে নিতে বলেন। কিন্তু ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড ৯টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও একটি আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারেননি তার স্বজনরা। অবশেষে তাকে বাঁচাতে হাসপাতালেই হাইফ্লো অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু এই একটি ঘটনা নয়, এ বছর করোনা পরিস্থিতিতে এরকম ঘটনা ঘটছে অহরহ। হঠাৎ করেই রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। করোনার সংক্রমণ আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, গত বছরে জুন- জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী ছিল কিন্তু তখনও এত অল্প সময়ে রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হতে দেখেননি তারা। অধিকাংশ রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বছর শুধু হাসপাতালের চিকিৎসায় চলছে না, প্রয়োজন পড়ছে আইসিইউর। আর সেখানেই বাধছে বিপদ। আইসিইউ জোগাড় করতে বিপাকে পড়ছেন রোগীর স্বজনরা। শয্যা ফাঁকা না থাকায় হাসপাতাল বাধ্য হচ্ছে রোগী ফিরিয়ে দিতে। বাড়ছে মৃত্যু। সংক্রমণ হার বাড়ছে হু হু করে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতেও সব জায়গায়তেই উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি। মাস্ক দেখা যায় না কারো মুখে।

দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন ডা. তুষার মাহমুদ। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সর্ম্পকে তিনি বলেন, গত বছরে চিকিৎসা দেওয়া ১০০ জন রোগীর মধ্যে তিনজনকে হাসপাতালে পাঠাতে হতো। অথচ গত কয়েকদিনে ১০০ জন রোগীর ২০ জনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। এসব রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ায় আইসিইউ সাপোর্টও লাগছে। যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিয়ে এতদিন রোগী সুস্থ করে তুলেছি এখন আর তা কাজ করছে না। রোগীদের জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে তরুণদের হার বেশি। তাই সুস্থ থাকতে হলে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

গত কয়েকদিন ধরে প্রায় সব জেলাতেই রোগী বাড়ছে। এর মধ্যে বরিশাল অঞ্চলে রোগী বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার সব কটিতেই এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হারও তুলনামূলক বেশি। রোগী বৃদ্ধি ও শনাক্তের হার বরিশালের পর বেশি দেখা যাচ্ছে ঢাকা ও খুলনা বিভাগে। শুরু থেকেই দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। মোট রোগীর প্রায় ৫৭ শতাংশ এ বিভাগের। এর বড় অংশই আবার রাজধানী ঢাকায়। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট শনাক্ত রোগীর ৫১ শতাংশ রাজধানীর বাসিন্দা। আর মোট মৃত্যুর ৩০ শতাংশই হয়েছে রাজধানীতে। ২৯টি জেলাকে সংক্রমণের হার বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী ও চাঁদপুর রয়েছে এই ২৯ জেলার মধ্যে। রাজধানীর বাইরে এখন কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুরে রোগী শনাক্তের হার বেশি। গত এক সপ্তাহে এসব জেলায় শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের ওপরে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরেও বাড়ছে নতুন রোগী।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ২৫ মার্চ পর্যন্ত আসা তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করার জন্য আমাদের একটা কমিটি করা আছে। সেই কমিটিকে আমরা জানিয়ে দিই কোন কোন জেলায় সংক্রমণের হার তুলনামূলক বেশি। ২৫ তারিখ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে আমরা ২৯টি জেলায় সংক্রমণের হার বেশি দেখতে পেয়েছি।এবার যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগ বয়সে তরুণ জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথম দিকে মানুষ বাইরে কম বের হতো। তখন আমরা দেখেছি যারা বাইরে যাচ্ছে, কাজে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে সংক্রমণের হার বেশি। এখন সবাই বাইরে বের হচ্ছে।
করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর একটি শয্যার জন্য হাহাকার চলছে। সরকারি হাসপাতালে তুলনামূলক খরচ কম হওয়ায় করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের স্বজনরা রোগী নিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন। কিন্তু কোথাও শয্যা খালি না পেয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালেও আগের তুলনায় আইসিইউ ভর্তিচ্ছু রোগীর চাপ অনেক বৃদ্ধির ফলে খালি আইসিইউ শয্যা প্রতিদিনই কমছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা সম্পর্কিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাজধানীতে করোনা ডেডিকেটেড ঘোষিত হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যার সংখ্যা ১০৮টি। তার মধ্যে ১০৪টি শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে। ফলে মাত্র চারটি শয্যা খালি রয়েছে। বেসরকারিভাবে করোনা ডেডিকেটেড ৯টি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১৮৮টি। তার মধ্যে রোগী ভর্তি রয়েছে ১৪৪টিতে। ফলে ২ কোটি জনসংখ্যার এই রাজধানীতে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মাত্র অর্ধশতাধিক আইসিইউ শয্যা ফাঁকা রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে একটি আইসিইউ বেডে প্রতিদিন অর্ধলাখের বেশি টাকা বিল পরিশোধের কথা শুনে অনেকে সেখানে রোগী ভর্তি করাতে সাহস পান না।

রাজধানীর ১০টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতাল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউের শয্যার সবকয়টিতে ভর্তি রয়েছেন রোগী। ২৫০ শয্যার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টির মধ্যে ১৪টিতে রোগী ভর্তি অর্থাৎ দুটি বেড ফাঁকা রয়েছে। আর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টির মধ্যে ১৩টিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। অর্থাৎ সেখানে দুটি শয্যা ফাঁকা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ২ হাজার ৪৬১টি সাধারণ শয্যায় এ মুহূর্তে রোগী ভর্তি ২ হাজার ১২৭ জন।

এ ব্যাপারে কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, নাগরিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। প্রশাসন ও নাগরিকদের সমন্বিত সচেতনতা ছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা নিতে হবে। শুধু এক দিন দেশের এক জায়গায় অভিযান চালালে হবে না। করোনা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের কোনায় কোনায়। এ জন্য দেশব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, চিকিৎসকসহ সব পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বাস, ট্রেন, গণপরিবহনে স্ক্রিনিং চালাতে হবে। চারদিক থেকে একযোগে কর্মসূচি নিলে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন