মো. শফিকুল ইসলাম : দেশে করোনায় গতকাল শনিবার সকাল আটটা পর্যন্ত গত ২৪ ঘন্টায় মারা গেছে আরো ৩৯ জন ও শনাক্ত তিন হাজার ৬৭৪ জন। মৃতদের মধ্যে ২৪ জন পুরুষ, ১৫ জন নারী। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে আট হাজার ৮৬৯ জনের। হঠাৎ করে দেশে কোভিড-১৯ শনাক্তে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে শনাক্তের হার ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে, রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতাল ঘুরে মিলছে না কাংখিত বেড ও প্রযোজনীয় জরুরী সেবা। রীতিমতো নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) বেডের জন্য সব হাসপাতালগুলোতে আবারো যেন নতুনভাবে হাহাকার অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে করোনা ডেডিকেটেড ঢাকার অন্যতম পাঁচ হাসপাতালে কোনো আইসিইউ ফাঁকা নেই। করোনা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় সরকারি আরো পাঁচটি হাসপাতালকে পুনরায় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটকে নতুন করে করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা গৃহিনী পিরোজা বেগম শনিবার বলেন, কোভিড রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে চিকিৎসকরা ভর্তি করাইতে চায় না। উনারা বলে জায়গা নেই। কিন্তু অনেক কান্নাকাটি করে আমি আমার মেয়েটাকে ভর্তি করাইছি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, হাসপাতালের নারী ও শিশু ওয়ার্ডটি করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ফিরোজার শিশুটির ঠিক পাশে ভর্তি হয়েছে স্ত্রীর দ্বারা হামলার শিকার হাফেজ মাও. কামাল হোসেন। কামাল জানালেন, হাসপাতালে এত রোগী, যে ভর্তিই করাইতে চায় না।
এসব বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। যার কারণে তালিকাভুক্ত হাসপাতালের সাধারণ বেড ও আইসিইউ সংকট চলছে। এমনকি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও বেড সংকট। বেডের অভাবে রোগীদের ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। সংক্রমণের হার এভাবে বাড়তে থাকলে করোনার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ও কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকে একজন রোগীর স্বজন হাসান সরকার বলেন, বড় ভাই করোনায় আক্তান্ত, নিয়ে আসছিলাম ভর্তির জন্য। কিন্তু এখানে বেড খালি নাই। তাই অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। বেড সংকটের কারণে করোনায় আক্রান্ত আরো তিন-চারজনকে শনিবার দুপুরে একটি অটোরিকশায় উঠতে দেখা যায়। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলে একজন বলেন, এখানে তো বেড খালি নাই। এখন মহাখালীর একটা হাসপাতালে যাইতাছি।
করোনায় আক্রান্ত ষাটোর্ধ্ব বাবার জন্য অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আরাফাত হোসেন বলেন, বাবার প্রথমে হালকা জ্বর হয়। সাথে কিছুটা কাশিও হয়। তাই করোনা টেস্ট করাই। রেজাল্ট পজিটিভ আসে। আগে থেকেই বাবার ডায়াবেটিস রয়েছে। তাই ঝুঁকি না নিয়ে তাকে প্রথমেই নিয়ে যাই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনি বেড খালি নেই। যানজট ঠেলে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়ার পথে বাবার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়ে। ফোনে একজন পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি দ্রুত কোনো আইসিইউ সাপোর্টে নেওয়ার পরামর্শ দেন। আতঙ্কিত হয়ে তখন ফোনেই ঢাকা মেডিক্যাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করি কিন্তু আইসিইউ খালি নেই।
আবরার হোসেন আরো বলেন, নিরুপায় হয়ে ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানেই চিকিৎসা চলে। এখন বাবা কিছুটা সুস্থ হলেও বিল পরিশোধ করতে বড় বিপদের মুখে পড়েছি। এত বিল আসবে কল্পনাও করতে পারিনি। সামর্থ্যও নেই। বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ বেডেও করোনা রোগীদের জন্য অনেক খরচ। সরকারি হাসপাতালে যদি বেড খালি পাওয়া যেত, তবে আমাদের এই অবস্থায় পড়তে হতো না। কেবল এই একজনই নয়, অনেকই সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ পাচ্ছেন না।
চিকিৎসকরা বলছেন, গত বছরের মে-জুন-জুলাইয়ের মতো আক্রান্ত বাড়ছে। প্রথমেই সবগুলো সরকারি আইসিইউ বেড পূর্ণ হয়ে গেলো। সাধারণ বেডও প্রায় পূর্ণ। অথচ কারো মাঝে একটু সতর্কতাও চোখে পড়ে না। ঊর্ধ্বগতি সংক্রমণের কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের বেড সংকট।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসির অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। যেসব দেশ স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, সেসব দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। আমাদের দেশে এখন কেউ মাস্ক পরতে চান না, স্বাস্থ্যবিধি মানতে চান না। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন হতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে কোভিড আক্রান্ত জটিল রোগীকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসিইউ ও কেবিন সাপোর্ট দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য রাজধানীতে কোভিড ডেডিকেটেড ১০ সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ছয়টিতে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। সূত্র মতে, কুর্মিটোলা হাসপাতালে ২৭৫ বেডের করোনা ইউনিটে রোগী আছে ৩৯৮ জন। অর্থাৎ ১২৩ জন অতিরিক্ত রোগী আছে এই হাসপাতালে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সরকারি কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো আইসিইউ বেড পরিপুর্ণ। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি বেডের মধ্যে চারটি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬টি বেডের মধ্যে একটি আর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি বেডের মধ্যে দুইটি বেড ফাঁকা রয়েছে। মোট ১০৩টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ৯৬টিতে রোগী আছে, খালি আছে ৭টি। এর মধ্যে দুটি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। বাকি আটটির মধ্যে পাঁচটিতেই সব কটি আইসিইউ বেড পরিপূর্ণ রোগীতে।
অপরদিকে, অধিদফতরের তালিকাভুক্ত ৯টি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ রয়েছে ১৬৪টি, তার মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ১২৬ জন, বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র ৩৮টি। ঢাকার প্রধান ১০টি সরকারি করোনা হাসপাতালের মোট দুই হাজার ৩৮১টি বেডের এক হাজার ৮৪৫টিতে রোগী রয়েছে। খালি আছে (গতকাল) ৫৩৬টি। অন্যদিকে ঢাকার ৯টি বড় বেসরকারি হাসপাতালের তিন হাজার ৩২১টি জেনারেল বেডের মধ্যে দুই হাজার ৩৩৩টি রোগীতে পূর্ণ, খালি আছে ৯৮৮টি। ওই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ২৬৭টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ২১০টিতে রোগী আছে এবং ৫৭টি খালি। সারাদেশের ১০ হাজার ৫০০টি জেনারেল বেডের মধ্যে সাত হাজার ৫৪৯টি খালি এবং দুই হাজার ৯৫১টিতে রোগী আছে। ৫৪৯টি আইসিইউ বেডের ৩০৬টিতে রোগী আছে এবং ২৪৩টি শূন্য।
এবিষয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী সার্জন ডা. সৈয়দ অলী মোহাম্মদ রাসেল দিন পরিবর্তনকে বলেন, সব ওয়ার্ডই প্রায় করোনা রোগীতে ভর্তি। আর সামনে আরো হবে। আইসিইউতে বেড পাওয়া এখন সোনার হরিণ। প্রতিদিন ওয়ার্ড থেকে গড়ে পাঁচ থেকে ১০ জন রোগী আইসিইউর অপেক্ষায় থাকে। গত মাসে পরিকল্পনা ছিল নন-কোভিড ওয়ার্ড চালু করা, তা আর হয়নি। এরপর অবস্থা বেগতিক দেখে ৭, ১১ ও ১২ তলা কেবিন ওয়ার্ড খুলে দিয়েছি। এখন অধিকাংশ ওয়ার্ডই পরিপূর্ণ। কোনও বেড ফাঁকা নাই।
বিভিন্ন জেলার রোগীরা রাজধানী ঢাকায় চলে আসায় করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে জানিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ঢাকার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। কেউ বুঝতেই চাচ্ছে না-পরিস্থিতি কতোটা ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে খুবই ভয়ঙ্কর হতে যাচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে আইসিইউ বেড কিছু ফাঁকা ছিল। এখন ফাঁকা নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে চাহিদা আসছে। বাধ্য হয়ে তাদের অপেক্ষায় রাখছি। গত কয়েকদিন রোগীর সংখ্যা একটু বেশি। বেশিরভাগই জ¦র, সর্দি আর শ^াসকষ্ট নিয়ে আসছেন। আউটডোরে বিভিন্ন ধরনের রোগীর দীর্ঘ লাইন থাকছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সাবেক উপদেষ্টা ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, দেশের বাইরে থেকে যারা আসছেন তাদের একটা বড় অংশ ঢাকাতেই থাকেন, এটা হচ্ছে করোনার উৎপত্তি। একইসঙ্গে ঢাকায় ঘনবসতি বেশি। নতুন স্ট্রেইনের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। আর মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। কেউ মাস্ক পরছে না, সামাজিক দুরত্বও মানছে না। যার কারণে পরিস্থিতিরি অবনতি হচ্ছে।