ঐতিহাসিক ও দ্বিপক্ষীয় চলমান সম্পর্কের যে বহুমাত্রিকতা রয়েছে, তা বিস্তৃতিতে জোর দিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশের গত পাঁচ দশকের সম্পর্কের মূল্যায়ন করে ভবিষ্যতের পথনকশা কেমন হবে- তা ঠিক করতেই শীর্ষ বৈঠকে বসেন দুই সরকারপ্রধান। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও বেগবান ও জোরদার হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এদিকে সম্পর্ক জোরদারে শীর্ষ বৈঠকের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাতটি উন্নয়ন প্রকল্পেরও উদ্বোধন করেন।
যে পাঁচ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, সেগুলো হলো- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা; বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এবং ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়ার (আইএনসিসি) মধ্যে সহযোগিতা; বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূর করতে একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা; বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার ও রেফারেন্স বই সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ সহযোগিতা এবং রাজশাহী কলেজ মাঠের উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন।
এ ছাড়া শিলাইদহের সংস্কারকৃত কুঠিবাড়ি, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসমাধি, ভারতের উপহার ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল, দুটি সীমান্তহাট উদ্বোধন এবং স্মারক ডাকটিকিটের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
শীর্ষ বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, চিরায়ত সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক নৈকট্য এবং ঐতিহাসিক মেলবন্ধনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত বহুমুখী অংশীদারত্ব বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে বিবর্তিত, বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘মডেল’ হিসেবে বিবেচ্য আমাদের এ অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে অনবদ্য দ্যোতনা দিয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সফর।
তিনি বলেন, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। সফরটি যদিও কিছুটা উদযাপনের; তার পরও সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা ও বিস্তৃত পরিসরে দুপক্ষের মধ্যে অত্যন্ত অর্থবহ আলোচনা হয়েছে। মানবসম্পদ ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাসবাদ অবসান এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রগতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্জিত অভূতপূর্ব সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব যৌথভাবে উদযাপনের বিভিন্ন পরিকল্পনাও তাদের আলোচনায় স্থান পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আগামী বছর ভারত সফরের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে আনা এবং বাণিজ্য অবারিত করা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। উভয় পক্ষ বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাধাগুলো অপসারণে গুরুত্বারোপ করেছে। বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য রপ্তানির ওপর ২০১৭ সাল থেকে ভারতের আরোপিত ফি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণে একযোগে কাজ করার ওপরও দুই প্রধানমন্ত্রী জোর দেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ভারতীয় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন দুই নেতা। সড়ক, রেল ও নৌপথে মাল্টিমোডাল কানেকটিভিটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। ‘ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড’ ত্রিপক্ষীয় প্রকল্পে যুক্ত হতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা ভারতকে জানানো হয়। ভারতীয় ভূখ- ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে আরও বৃহত্তর পরিসরে সংযোগ বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য বাংলাদেশ নতুন কিছু রুট অনুমোদনে ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে দূরত্ব, সময় ও ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়বে।
সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া ‘চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেলরুট’ ব্যবহার করে ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের রেল কানেকটিভিটি স্থাপনের বিষয়ে আমাদের আগ্রহের কথাও ভারতকে জানানো হয়েছে। ফেনী নদীর ওপর সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া ‘মৈত্রী সেতু’র কথা উল্লেখ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে পরিবহন সংযোগ স্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশের উদার সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার ওপর অলঙ্ঘনীয় অধিকারের বিষয়টি বরাবরের মতোই জোরালোভাবে উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তিস্তার পানিবণ্টনের ‘অন্তর্বর্তী চুক্তি’ দ্রুত সম্পাদনের জোর দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। নরেন্দ্র মোদি জানান, চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এ বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমারÑ এই ছয় নদীর পানিবণ্টনের অন্তর্বর্তী চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্তকরণের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে দুই দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার বিষয়ে উভয় নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে ভারত। সীমান্তে একজন বাংলাদেশিও যেন কোনো কারণেই বিএসএফের হাতে নিহত না হন, সেটি নিশ্চিত করার জোরালো দাবি উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত শুক্রবার ঢাকায় আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেদিন তিনি ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল জাদুঘর উদ্বোধন করেন। গতকাল সকালে সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জে মন্দির পরিদর্শন এবং টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকায় ফেরেন। বিশ্বের কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের এটিই ছিল প্রথম টুঙ্গিপাড়া দর্শন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাদের পৈতৃক ভিটায় স্বাগত জানান নরেন্দ্র মোদিকে। সেখানে জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি যান। সেখানে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়িতে এক মতবিনিমিয়সভায় মিলিত হন।
যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করে দেবে ভারত
সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি সাতক্ষীরায় একটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। শনিবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে পৌঁছান। তাকে স্বাগত জানান মন্দিরের সেবায়েত পরিবারের সদস্য জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় (জয়তি চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী)। এ সময় তাকে ঐতিহ্যবাহী ঢাক-ঢোল এবং শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়।
সেখানে মোদি বলেন, যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে এসে মা কালীর আশীর্বাদ নিতে পারার সুযোগ পেয়ে আমি খুশি।’ বাসস জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সকালে জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে শতবর্ষের পুরনো যশোরেশ্বরী কালীমন্দির পরিদর্শন করেন। সকাল ১০টা ১০ মিনিটে মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং তিনি ১০টা ২২ মিনিটে দেবী কালীর নামে পুরনো এই যশোরেশ্বরী মন্দিরে পূজা-অর্চনা সম্পন্ন করেন। মন্দিরের ভেতরে মোদি মাস্ক পরেছিলেন এবং মন্দিরের মেঝেতে বসে প্রার্থনায় অংশ নেন। নরেন্দ্র মোদি এ সময় কালীমাতাকে সোনার মুকুট, লালগুজরাটি শাড়ি, ফল ও মিষ্টি নিবেদন করেন। পরে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ভক্তদের সঙ্গে ফটোসেশন করেন।
ফিরে গেলেন মোদি
দুদিনের ব্যস্ত সময় শেষে দেশে ফিরে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় বিশেষ একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নয়াদিল্লির পথে রওনা হন। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন।
পাঁচ সমঝোতা স্মারক
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও প্রশমনে সহযোগিতা; বিএনসিসি এবং আইএনসিসির মধ্যে সহযোগিতা; অশুল্ক বাধা দূরে সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা; দুই দেশের বিজিএসটি সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার, রেফারেন্স বই সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ সহযোগিতা এবং রাজশাহী কলেজ মাঠের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন।
ছয়টি নদীর পানিবণ্টনের অন্তর্বর্তী চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্তকরণে দুই দেশের মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা।
পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে ভারতের আরোপিত ফি প্রত্যাহারে অনুরোধ।