মো. শফিকুল ইসলাম: দাপটের সঙ্গে বিএনপির রাজপথের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন যারা তাদের অনেকেই বার্ধক্যের জন্য রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারছেন না। অবসরে চলে গেছেন আবার কেউ কেউ। অনেকে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সরকারের রোষানলে পড়ে কেউ রয়েছেন কারগারে। অনেকে মামলা মাথায় নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাই বলে থেমে নেই বিএনপি রাজনীতি। তাদের তরুণ সন্তানরা এখন পুর্বপুরুষদের রাজনীতির রাজত্বের হাল ধরছেন। ঝিমিয়ে পড়া বিএনপিকে রাজপথে চাঙ্গা করতে সক্রিয় হচ্ছেন তরুণ নেতাকর্মীরা। নিয়ন্ত্রণ করছেন রাজপথের রাজনীতি। আবার কেউ নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও যোগ্যতাবলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিএনপিতে এক ঝাঁক তরুণ নেতৃত্বে উত্থান ঘটেছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
তারা বলছেন, তরুণ নেতাদের ঘিরে একট্টা হচ্ছে দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে বাসায় বাসায় লবিং করা আর মিডিয়ার ক্যামেরায় মুখ দেখানোর কালচারের বাইরে এদের অবস্থান। বিপদে কর্মীদের বুকের মধ্যে যেমন আগলে রাখে ঠিক তেমনিভাবে খোঁজ খবর নিতে ছুটে চলছেন তাদের বাসায়। বিএনপির কর্মী সমর্থকদের আস্থায় ভাসছেন এসব তরুণ নেতারা। বিএনপি মহলের সবত্রই ছড়িয়ে পড়েছে তাদের অর্জন। পারিবারিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে এসেছেন তারা। তাদের তৎপর হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়া দলটির নেতাকর্মীরা নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছেন এবং দলের সাংগঠনিক শক্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের হাত ধরে তরুণ নেতৃত্বে বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন তৃণমূল থেকে বিএনপির শীষ পর্যায়ের নেতারা।
জানা গেছে, রাজপথের রাজনীতি সক্রিয় করার পেছনে শীষ পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন কয়েকজন তরুণ নেতা। যাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপি নেতা ও আর্ন্তজাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন ও তাবিথ আওয়াল, যুগ্ম মহাচিসব হাবীব উন নবী খান সোহেল, বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মীর হেলাল, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুন রায় চৌধুরী সহ কয়েকজন তরুণ নেতা।
বিএনপির নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দল নানা অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে রাজপথে আন্দোলনের চেষ্টা করলেও সেভাবে সক্রিয় হতে পারেনি। কিন্তু চলতি বছরে তরুণ নেতৃত্বে দলের কর্মীরা আন্দোলনে সক্রিয় হচ্ছেন। স্থবির ও গুটিয়ে যাওয়া বিএনপির আন্দোলন হঠাৎ চাঙ্গা হওয়ার পেছনে এসব তরুণ নেতাদের ভূমিকা অনেক। ইতিমধ্যে দলটির হাইকমান্ডও তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত করতেও অগ্রণী অবস্থান তাদের। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিকে সফল করতে উদ্যোগী রয়েছেন এইসব তরুণ নেতৃবৃন্দ। সরকার পতনের আন্দোলনে এরাই বিএনপি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবে বলে আশা করছেন তারা।
তৃনমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, সাম্প্রতিক অতীতে বিএনপির কার্যক্রম প্রতীকী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কয়েকজন মুখচেনা নেতার প্রতিদিন ব্যানার হাতে এতিমের মতো দাঁড়িয়ে থাকা দেখে মনেই হতো না বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান গণসংগঠন। সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিএনপি। ‘ব্র্যাকেটে বন্দী’ গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য এসব ডায়নামিক নেতাদের দলে আরো বেশি প্রয়োজন। তাদের হাত ধরেই গণতন্ত্র পুরুদ্বার, দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত হবে বাংলাদেশ।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, ইশরাক ঢাকার পাড়ায় মহল্লায় কাজের পাশাপাশি বিএনপির দেশব্যাপী কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। কর্মী সমর্থকদের বিপদে ছুটে যাচ্ছেন। রাজধানীতে বিএনপির রাজনীতিতে বিরাজমান শূন্যতা অনেকাংশে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়া সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশের হাত থেকে কর্মী ছিনিয়ে নিয়ে আসায় দেশজুড়ে তার নেতৃত্বে বিএনপির কর্মী সর্মথকদের মনোবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাকে ঘিরে আশা দেখছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এটা প্রমাণিত হয়েছে বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে। তাকে দেখতে তৃণমুলের নেতাকর্মীরা ছুটে এসেছেন সমাবেশে। তার বাবার মতো তিনিও গণতন্ত্র পুরুদ্ধারে রাজপথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন বলে বিশ্বাস করছেন নেতাকর্মীরা। রাজপথের রাজনীতি সক্রিয় করছেন ঢাকার আরেক কান্ডারি তাবিখ আওয়াল। নগরবাসীর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততাও বেশি। আন্দোলন-সংগ্রামে ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া দলের হয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কাজ করছেন তারা।
তারা আরো বলছেন, এর কয়েকদিনের ব্যবধানে ছাত্রদলের কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিচার্জ থেকে ছাত্রদলের নেতাকে বাচাঁতে ছুটে আসেন নবী সোহেল। পুলিশ তাকে লাঠিচার্জ শিকার হলেও কর্মীদের সামনে থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। তবুও রাজপথে কর্মীদের পুলিশের কাছে একা ছেড়ে যায়নি।
মীর হেলাল কেন্দ্রীয়ভাবে কাজের পাশাপাশি চট্টগ্রামে বিএনপিকে তৎপর ও শক্তিশালী করতে দিনরাত কাজ করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রতিদিন নানা কর্মসূচিতে তাকে সরব দেখা যাচ্ছে।
শামা ওবায়েদ বিএনপির পক্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের সাংগঠনিক তৎপরতার অংশ হিসেবে সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন এবং ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে জনসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
নিপুন রায় চোধুরী সারাদেশের নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। নির্যাতন প্রতিরোধে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন। ভিকটিমদের আইনগত ও চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি সারাদেশে ধর্ষণ, খুন-গুমের প্রতিবাদে বাংলাদেশের মানুষ সোচ্চার করছেন। দেশের নারী ও শিশু অধিকার রক্ষার যাবতীয় কার্যক্রমকে শক্তিশালী ও বেগবান করছেন।
বিএনপি ও যুবদলের নেতারা জানায়, বিএনপির অবক্ষয়ের প্রধান কারণ নেতৃত্বের শূন্যতা। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকের নামই কর্মী সমর্থকদের অজানা। কখনো চেহারা দেখা যায় না, এমন নেতাই দলে বেশি। তাছাড়া টকশো করে ও মিডিয়ার মুখ দেখিয়ে বহুজন দলের পদপদবী বাগিয়ে বসে আছেন। এদের দ্বারা দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পায়নি এবং আন্দোলনেও গতি আসেনি। আন্দোলনের মাঠ থেকে যেসব তরুণ নেতার উত্থান হচ্ছে, তাদের প্রতিই দলের তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের আস্থা রয়েছে। যার প্রতিফলন সাম্প্রতিককালে রাজনীতির মাঠে দেখা যাচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে ইশরাক দিন পরিবর্তনকে বলেন, লাঠিচার্জ অথবা কামানের গোলা যেটাই আসুক আমার জান থাকতে দলের একজন কর্মী সমর্থকেও হামলার শিকার হতে দিবো না। পুলিশও কাউকে নিয়ে যেতে পারবে না। আমার বাবা দেশ ও মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। আমিও জণগণের জন্য রাজনীতির মাঠে নেমেছি।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের ক্যান্ডারবাহিনী মামলা হামলা শিকার হয়েও রাজপথে এখনো দলের নেতাকমীরা আছে এবং থাকবে। সরকারের গুম-খুন নির্যাতন সহ বিভিন্ন কর্মকান্ড তুলে ধরে দেশের জণগণকে রাজপথে নিয়ে আসবো। বিএনপি হাত ধরেই দেশের মানুষ এই স্বেরাচার সরকারের হাত থেকে মুক্ত পাবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু এই প্রতিবেদককে বলেন, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তরুণ, মেধাবী ও দলের জন্য নিবেদিত এবং ডায়নামিক নেতৃত্বের প্রয়োজন। দলের প্রতি শতভাগ আনুগত্য কূটনীতিক ও রাজনৈতিক এবং ডিজিটাল বিষয়েও সম্ভাব্য তরুণ নেতাদের বেশি পারদর্শী হতে হবে। তাদের সরাসরি দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হতে পারে অথবা দলের বাইরে রেখে দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করবেন তারা।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, দলকে চাঙ্গা করতে হলে তারুণ্যনির্ভর নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সরকারবিরোধী আন্দোলন ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায়ে যোগ্য তরুণ নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, পদ আঁকড়ে রাখলে নেতৃত্ব তৈরি হয় না, নেতা তৈরি করতে হলে তরুণদের নেতৃত্বে আনতে হবে। তরুণরা নেতৃত্বে এলে দলে গতিশীলতা আসবে। তরুণ-প্রবীণ সংমিশ্রণে কাঁধে কাধ মিলিয়ে রাজপথে সরকার পতনের আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি।