তার শতবর্ষ পেরিয়ে প্রথম জন্মদিনে আমাদের মনে পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের উক্তি। তিনি লিখেছিলেন- বটগাছের পূর্ণ রূপ দেখতে হলে দূর থেকেই দেখতে হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের ইতিহাসের বটবৃক্ষ, মহানায়ক। সে কি কেবল মুখের কথা? আমরা কি তার বিশালত্ব বুঝতে পারি, সকলেই?
বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে নেতা হয়ে আসেননি, আজকাল যেমন হচ্ছে। নেতৃত্বে নিজের অবস্থান নিয়ে সমস্যা হলে তারা কখনো আপস করেন, দল পাল্টান, কখনো বা সরে দাঁড়িয়েছেন। আজকাল এটা প্রায় একচেটিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ তারা নেতার আসন ছাড়া অন্য কোনোভাবে নিজেদের ভাবতে পারেন না।
আমরা সকলেই জানি বঙ্গবন্ধু একজন সাধারণ ছাত্রকর্মী থেকে রাজনৈতিক কর্মী হয়েছেন এবং তার পর দলের ছোট নেতার ভূমিকায় সংগঠকরূপে মূল দায়িত্ব পালন করে ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেছেন। আর এক সময় দল ছাপিয়ে জাতির নেতা, ইতিহাসের মহানায়ক এবং জাতীয় জীবনের অমর ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
মুসলিম লীগে নেতা ছিলেন অনেক, কর্মীও ছিল অনেক; কিন্তু কর্মী থেকে নেতা হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। কারণ কর্মী ক্রমে নেতৃত্বে উঠে আসেন আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। মুসলিম লীগ সংগঠন হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল বটে; কিন্তু সেটি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভেতর দিয়েই চলেছিল। সংগঠন এমন কোনো সংগ্রাম দাঁড় করাতে পারেনি বা চায়নি, যা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার পর্যায়ে যেতে পারে। আর পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কাজ একদিকে সাম্প্রদায়িক রূপ নেয় সহজেই, অন্যদিকে ক্ষমতা কব্জা করার দিকে মনোযোগী হয়। ফলে কর্মীরা সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কাজে জড়িয়েছে আর নেতারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে গিয়ে কর্মীদের বাড়তে দেননি, পরিণামে সংগঠনের বিকাশও রুদ্ধ হয়েছে। সংগঠন জড়িয়ে পড়েছে ক্ষমতার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে। সেই দল বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দীর্ঘদিন করা সম্ভব ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই তাকে নতুন দল গড়ার কাজে যুক্ত হতে দেখি। ১৯৪৯ সালে গড়ে ওঠে নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লীগ।
তরুণ মুজিব এই সংগঠনের কাজে মনপ্রাণ ঢেলে দেন। বঙ্গবন্ধু বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক দাবি পূরণের লক্ষ্য নিয়ে তার দলকে একের পর এক আন্দোলনে জড়িয়েছেন, তখন দলের সর্বস্তরের কর্মীদের বরাবর সংগ্রামে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং তার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক আদর্শের কারণে নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আর এভাবে লাগাতার সংগ্রামে শরিক থেকে সংগঠন শক্ত জমির ওপর দাঁড়িয়েছে, বিপুল কর্মীদল হয়ে উঠেছিল সংগঠনের প্রাণ। এক সময় এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু যেমন আপামর মানুষের নেতা হয়ে উঠলেন, তেমনি আওয়ামী লীগও হয়ে উঠেছিল গণমানুষের দল। এ দলের এমন শক্ত ভিত্তি ছিল বলে পঁচাত্তরের পরে এত দমন-পীড়ন এবং লোভ-প্রলোভন অনেকের দল ত্যাগ বা দলে বিভাজন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়নি। এটি নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় অবদান। আওয়ামী লীগ টিকে না থাকলে, সংগ্রামী প্রতিরোধের নেতৃত্ব না দিলে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর যেভাবে দুই সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদ দেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করেছিলেন, মৌলবাদী ধর্মান্ধ শক্তির উত্থানে সহায়তা দিয়েছেন এবং এর পর বেগম জিয়া যেভাবে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদকে লালন করেছেন, তাতে বাংলাদেশের পক্ষে ফিরে বাংলাদেশ হয়ে ওঠার চেষ্টা করাও হতো কঠিন।
বঙ্গবন্ধু তার মূল কাজ স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন একাত্তরেই; কিন্তু এ লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশকে অভূতপূর্ব ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, যার ফলে দেশ পুনর্গঠন এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। এর মধ্যেও সংবিধান প্রণয়ন, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মতো মৌলিক কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। তার নেতৃত্বেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশ সদস্যপদ পেয়েছিল। তখনও বাকি ছিল অর্থনৈতিকভাবে দেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো বা দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন। জনপ্রশাসনকে গণমুখী ও দক্ষ ভিত্তি দান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা ও স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত এগুলোর বিস্তৃতি ঘটানোর কাজও আরব্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু তার স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশগঠনের কাজ অসমাপ্ত রেখে নিহত হলেন।
তার পর দীর্ঘ কুড়ি বছরের বৈরী শাসন সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সত্যিকারের বাংলাদেশ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছে; এর কারণ এত বাধা-বিপত্তি, নির্যাতন-বিপর্যয় এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী দলছুট হলেও এক সময় শক্ত হাতে বিপর্যস্ত দলের হাল ধরেছেন তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের জাতীয় জীবনে বঙ্গবন্ধুর বড় অবদান হলো- ছয়দফা-পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত করা। বঙ্গবন্ধু সবসময় জোর দিয়েছেন সংগঠনের শক্তির ওপর। তার ত্যাগী রাজনৈতিক আদর্শের টানে বৈরী পরিবেশেও বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি যে নিঃশেষ হয়নি, তার কারণ আশি-নব্বইয়ের দশক অবধি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর দেশব্যাপী ছড়ানো কর্মীবাহিনী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের আদর্শকে ধরে মাঠে সক্রিয় ছিল।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের স্বাধীনতার মূল স্থপতি, বহু মানুষের স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন একদিন; কিন্তু সে পাকিস্তান দুই যুগের মধ্যে দ্বিখ-িত হয়েছে, আর তার দল বহুধা বিভক্ত হয়েছে, অন্তত একটি খ-ে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশেও আমরা বহু রাজনৈতিক দলের জন্ম ও বিলুপ্ত দেখেছি; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পরও তার নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ টিকে আছে, উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে, তার দল টিকে আছে- আদর্শ নিয়ে সংশয় থাকলেও শক্তি নিয়ে নেই।
তবে এই দল যে বাহাত্তর বছর ধরে সগর্বে টিকে আছে, প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তার কারণ প্রেরণা হিসেবে এখনো আছেন বঙ্গবন্ধু- তিনি প্রায় অর্ধশতক ধরে অনুপস্থিত থাকলেও তার স্মৃতি এখনো জীবন্ত। এত বছর ধরে তিনি প্রেরণা হয়েই টিকে আছেন, ইতিহাস হয়ে আলোচনায় আছেন, নানা উপলক্ষে তাকে বারবার স্মরণ করা হয়েছে, তাকে নিয়ে যত কবিতা ও গান রচিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে- এমনটা এ বিশ্বে আর কোনো রাজনীতিকের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু এভাবে আমাদের ইতিহাসেরও গতিপথকে যেন পথনির্দেশনা দিয়ে চলেছেন।
বঙ্গবন্ধুর অবদান ও স্মৃতি অম্লান রাখার দায়িত্ব ইতিহাস দিয়েছে তার কন্যার কাঁধে। তারও রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে ক্ষমতার বাইরে, বৈরি শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। সংগ্রাম ও সংগঠন পরিচালনার অভিজ্ঞতা তাকেও নেত্রী হিসেবে তৈরি করেছে।
এখন একদিকে পুরনো আদর্শ ও স্বপ্নের অবসান হয়েছে, বাজার অর্থনীতির দাপটে নতুন এক ভোগবাদী সমাজের উত্থান হয়েছে, ত্যাগীকর্মী ও নেতার সংখ্যা দারুণভাবে কমে গেছে, প্রতিপক্ষের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার কৌশলও পাল্টেছে। তার মধ্যে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হওয়ায় সমাজে গণতান্ত্রিক ঔদার্য ও সহিষ্ণুতার পরিবেশ নেই। ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উৎপাত প্রশমিত করা সম্ভব হলেও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এবং তা থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালির চিরায়ত উদার মানবিকতার বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু সংকীর্ণতার প্রতাপ বেড়েছে। এটি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার পরিপন্থী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত হাতে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার কাজ করছেন। মানুষের আস্থাও তিনি পাচ্ছেন। তবে নিরাপত্তা যখন প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠে, তখন মানুষের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হয়, যার অর্থ গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হওয়া। ডিজিটাল আইনে নিরাপত্তা ও তার প্রয়োগে সম্প্রতি তা আরও প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে নিরাপত্তা ও আদর্শিক প্রত্যাঘাত নিয়ে অস্থিরতার এ পর্যায়টি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা দরকার। আমাদের ফিরে আসতে হবে সহনশীল মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়। তা হলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ কায়েম করা সম্ভব হবে। এখানেই আজকের নেতৃত্বের মূল পরীক্ষা। এই লক্ষ্য পূরণে বর্তমান নেতৃত্ব কত দ্রুত কতটা সফল হন, তার ওপর নির্ভর করবে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ধারাবাহিকতা কতটা-কীভাবে রক্ষিত হবে তা।
আজকেও অতীতের মতোই জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন, যা সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু এ দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। আজ জঙ্গিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ চলছে, তার সম্পূর্ণ সুফল সমাজে ছড়িয়ে দিতে আবারও চাই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য এবং সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব। এটিই আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আশার কথা- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক-সামাজিক দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িক মানবতার প্রতি তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশের মধ্যে আগ্রহের আভাস আমরা দেখতে পাচ্ছি। জঙ্গি ও জঙ্গিদের সমর্থক পৃষ্ঠপোষকরা ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বলেই আমাদের ধারণা। শেখ হাসিনাও দ্রুত গণতান্ত্রিক বাতাবরণ ফিরিয়ে আনায় যত্নশীল হবেন- সেটাও আমাদের প্রত্যাশা।
আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে আমাদের জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার শপথ নিতে হবে এবং এভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে।