মোঃ জিয়াউল হক হাওলাদার: যে কোন সমাজের বা জাতির দ্রুত এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবাদন রাখতে পারে সেই দেশের তরুণ সমাজ। তবে সেই তরুণ সমাজকে হতে হবে চিন্তাচেতনায় আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক, শিক্ষিত এবং দক্ষ, সর্বোপরি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত। মাদক এবং জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান হতে হবে কঠোর। তরুণ সমাজকে চিনতে হবে এবং জানতে হবে তাঁদের কালজয়ী নেতৃত্বকে। সেই নেতার আদর্শ অনুসরণ করতে হবে, তাঁর দর্শনকে দেশের উন্নয়নে প্রয়োগ করতে হবে।
বাঙ্গালি জাতির জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু একজন মহান আদর্শবান ব্যক্তিত্ব, দেশপ্রেমে অনন্য, মানবতাবাদী ও জনকল্যাণে এক মহানপুরুষ। যিনি বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের এবং নিজ পরিবারের সর্বসুখ, শান্তি, ত্যাগ করে তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে জেল খেটেছেন ৪ হাজার ৬৮২ দিন অর্থাৎ ১২ বছরেরও বেশি। বিশ্বের কম নেতাই আছেন যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এতোদিন জেল খেটেছেন। বাঙ্গালির জন্য তাঁর পরম মমতা, ভালোবাসা তাঁকে বাঙ্গালি জাতির হৃদয়ে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
তরুণ মুজিব ছাত্রাবস্থা থেকেই এদেশের মানুষের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার জন্য লড়াই করেছেন। মৃত্যুভয় তাঁর ছিলনা। তিনি ছিলেন এক অসীম সাহসী সিংহপুরুষ। এই সিংহপুরষের ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র বাঙ্গালি জাতিকে এক কাতারে সমবেত করেছিলেন। তাঁর এই কালজয়ী ভাষণ আজও পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে একটি । এই ভাষণটি সর্বদাই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে উজ্জ্বীবিত করে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তরুণ প্রজন্মকে দেশের উন্নয়নে আত্মনিবেদিত হওয়ার জন্য অনেকগুলো অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি কবি জীবনান্দ দাশের মা কুসুমকুমারি দাশ এর কবিতার উদ্ধৃতি দিতেন
“মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন/ মানুষ হইতে হবে — এই তার পণ।”
বঙ্গবন্ধু ছিলেন এশিয়া মহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠক। তিনি তরুণ সমাজের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি তাঁর চিন্তাকে এবং আদর্শকে তরুণ সমাজের মাঝে খুব দ্রুত সঞ্চার করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুর মোহনীয় জাদুর ক্ষমতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এবং ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে দেশের তরুণ সমাজের এক অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেদিকে যেতেন হাজার হাজার তরুণ তাঁর দিকে ধাবিত হতো। এ এক বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি ছিলেন। হিমালয় পর্বতের মতো তিনি লক্ষ্য অর্জনের বিশ্বাসে অটল ছিলেন। তাই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের শত নির্যাতন, কস্ট, জেল-ঝুলুম, হুলিয়া স্বত্বেও দেশপ্রেমের আদর্শ থেকে একবিন্দুও টলেননি। এরকম আদর্শের তরুণ সমাজ বঙ্গবন্ধু এদেশে দেখতে চেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। সেই তরুণ প্রজন্ম হতে হবে সাহসী, তেজে ভরা মনের অধিকারি।
১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন – বাঙালির মুক্তির সনদ – বঙ্গবন্ধু যখন ঘোষণা করলেন, এদেশের কোটি তরুণ এতে তাঁদের আশা-আকাঙ্খা এবং স্বপ্নের প্রতিফলন দেখতে পেলেন। এদশের তরুণ ছাত্র-সমাজ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আন্দোলনে শরিক হয়ে পাকিস্তানি শাসকদের ভীত প্রকম্পিত করে দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে এদেশের তরুণ-যুব ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধুর এক নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বঙ্গবন্ধুর উপর তরুণ সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা ছিল । তাঁরা বিশ্বাস করতো বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতির একমাত্র ত্রানকর্তা।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, তাঁর দর্শন সম্পর্কে জানতে হলে নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বই ভালো করে পড়তে হবে এবং গভীরভাবে আত্মস্থ করতে হবে । বইগুলো হচ্ছে – ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’। আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন আবুল মনসুর আহমেদ এর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ পড়েছি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশিত হলো এবং বই দুটি পড়লাম, তখন মনে হলো আবুল মসনুর আহমেদ এর সেই বইটির আর কোন আবেদন আমার কাছে নেই। অর্থাৎ আমি তরুণ প্রজন্ম হিসাবে বাঙালী জাতির অভুদ্যয়, উথ্থান এবং আমাদের স্বাধীনতা অর্জন একটি অখন্ড এবং পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেলাম। আমাদের তরুণ প্রজন্মের সকলকে বঙ্গবন্ধুর লেখা ৩টি বই পড়তে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর উপর প্রকাশিত সকল গবেষণাসমূহ পড়তে হবে।
২০১৮ সালে জার্মান মিডিয়া ডয়েচ ভেলে ‘নতুন প্রজন্মের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক একটি মতামত জরিপ বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে চালিয়েছিল। ঐ মতামতে প্রাপ্ত উল্ল্যেখযোগ্য মতামত হচ্ছে এরকম: বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম সকল তরুণদের জন্য অনুসরণীয়। এই দেশপ্রেম অনুসরণ করতে পারলে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। একজন তরুণ হিসাবে বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন একজন আদর্শ মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্ব, আদর্শ, গুণাবলী নিজের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি, তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী মানুষ। বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর আদর্শ চিরভাস্বর ও বিশাল ব্যক্তিত্ব সর্বদাই অনুসরণীয়।
জাতির পিতার স্বপ্নপূরণ করবার দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত ১৭ মার্চ ২০২০ মুজিববর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তোমরা দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালবাসবে। অনেক ত্যাগের বিনিমেয়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলার উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে তোমাদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। ঠিক যেভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষকে ভালোবেসেছিলেন, সেভাবেই ভালোবাসতে হবে। তাঁর আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।”
সূতরাং আমাদের সকলের তরুণদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যাতে করে আমরা নিজেরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুসরণ করতে পারি এবং তাঁর দর্শনকে লালন ও প্রয়োগ করে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে আমাদের মন-মনন-মেধা-চিন্তাকে সপ্রতিভ এবং শানিত করতে হবে। আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে আগামী ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর ন্যায় আজীবন আত্মতাগে বলিয়ান হয়ে সর্বোচ্চ পরিশ্রম করে যাবো, এই হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
লেখক: ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ), বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন।