মো. শফিকুল ইসলাম: বিএনপির জোটের রাজনীতি কাগজে-কলমে শুধু টিকে আছে। কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকটা নামের উপরই চলছে জোট। ইস্যুভিত্তিক মাঠের রাজনীতিতে জোটের ঐক্যবদ্ধভাবে দেখা যায় না, চলছে যে যার মতো। জোটের রাজনীতিতে ঐক্যের বদলে ‘একলা চলো’ নীতিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বিএনপি। জোটে আছে কিন্তু শরিকদের কোনো কর্মসূচিতে রাখছে না দলটি। শরিক দলের নেতাদের সাথে হচ্ছে না কোন বৈঠক। এমনকি জোটের আগামী দিনের কোন কর্মসূচির কথাও বলতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের কার্যক্রম যেন অনেকটাই নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, বিএনপির একলা চলো নীতির কারণে জোটের শরিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। বিভিন্ন কর্মসূচি ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব না দেয়ায় শরিকদের কারো কারো ভেতরে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। সিটি নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনেও অংশ নেয়নি তারা। বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গে ছিলেন না ভোটের মাঠে। আন্দোলন-সংগ্রামেও রাজপথে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এছাড়াও জামায়াত ইসলামীকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। বিএনপির স্বাধীনতা সূবর্ণ জয়ন্তী কর্মসূচিতে নেই জোটের অধিকাংশ দলই। একই সময়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য নামের আরো একটি জোট গঠন করার কথা বলছে বিএনপি। এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে প্রস্তবনা।
জোটের নেতারা মনে করছেন, জোট ‘সক্রিয়’ থাকলেও ‘কর্মসূচি’ নেই। বিএনপির কাছে এ মুহূর্তে স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তী পালন কার্যকরতাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। জোটে এখন চলছে আশানিরাশার দোলাচলে। নতুন করে বিএনপি নেতৃত্বধীন দুই জোট গতিশীল করার কোন কার্যক্রম ও আশার আলো দেখছে না জোট সংশ্লিষ্টরা। এমনকি আগামী দিনেও জোট নিয়ে বিএনপি কতদূর এগোবে তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীদের বড় অংশই বলছেন, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে নিয়ে মাঠের আন্দোলনে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। বিএনপি দেশের সবচেয়ে একটি বড় রাজনৈতিক দল। লাখ লাখ নেতা-কর্মী বিএনপির তৃণমূল পর্যন্ত নিজস্ব একটি শক্তি আছে। আগামী দিনেও বিএনপিকে নিজের শক্তিতেই দাঁড়ানো উচিত। জোট-ফ্রন্টের নির্ভরতা থেকে সরে আসা জরুরি। তাদের বিতর্কিত কর্মকান্ডের দায় বিএনপি নিতে পারে না। এতে দলের নেতাকর্মীরাও মূল্যায়িত হবে এবং সংগঠন হিসেবেও দল আরো শক্তিশালী হবে।
সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটে থাকা জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, লেবার পার্টি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করলেও বাকি দলের কোনো তৎপরতা নেই। অনেক দলেরই কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। অধিকাংশ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত নেই। কেন্দ্রীয় কমিটি থাকলেও নেই জেলা কমিটি। কয়েকটি আবার এক ব্যক্তির এক দল নামেও পরিচিত। অধিকাংশ দল চলছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শরিকদের একই অবস্থা। নিজেদের মধ্যে চলছে গ্রুপিং ও কোন্দল।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, এমনিতেই জোটের শরিকদের অধিকাংশ দলেই নেই কোনো অস্তিত্ব। তারা বিএনপির কাঁধে ভর করে তরী পার হতে চায়। অন্যদিকে জোটের অংশ ঠিক রাখতে গিয়ে জোট ত্যাগ করা দলগুলোর এমন সব নেতাদের নিয়ে নতুন দল বানানো হয়েছে যাদের নিজেদের দলের একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি লেখারও কোনো যোগ্যতা নেই। এই সব দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি কী করতে চায় তা বিএনপিও জানে না।
জোটবদ্ধ কর্মসূচি কেন দিচ্ছেন না জানতে চাইলে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, বিএনপির সাথে জোটের কোন দুরত্ব নেই। জোটবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই অনেক দিন। বিএনপি আলাদা ভাবে কর্মসূচি পালন করছে। সাংগঠনিক ভাবে গোছাচ্ছে দল বিএনপি। একই সাথে জোটের শরিকদল গুলোও সাংগঠনিক ভাবে দল গোছাছে।
তিনি বলেন, জোটের ভেতরে বেশ কিছু দল আছে যাদের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল, নেতৃত্বের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরাও বিএনপির সঙ্গে যেমন জোট করেছি, উনারাও সেভাবে জোটে আসছেন। এখন বিএনপি তাদের কেন নিয়েছে, কেন রাখছে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে বিএনপিকেই। স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তীতে ঐক্যফ্রন্টকেও রাখেনি। বিএনপি আলাদা ভাবে স্বাধীনতা সুর্বণজয়ন্তী পালন করছে।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) মহাসচিব ডা. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, শরিকদের সাথে নিয়ে কর্মসুচি পালন করেছে না কেন বিএনপিই ভালো বলতে পারবেন। যেহেতু আমরা নির্বাচনে একজোট ছিলাম। তাই আমাদের সাথে আলোচনা করে কর্মসূচি দেওয়া উচিত ছিল। আগের চেয়ে জোট আরো মজবুত হতো। আমাদের কোন অভিমান নেই তবে আমাদের মনোকষ্ট আছে। স্বাধীনতা আমাদের সবার ব্যাপার। আমাদের দলের পক্ষ থেকেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কর্মসূচি রয়েছে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০ দলীয় জোটের কোনো কর্মসূচি নেই। আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে ২৬ মার্চে ঢাকায় শোভাযাত্রা, মার্চের মাঝামাঝি ঢাকায় সমাবেশ করব। এছাড়া সারাদেশে দোয়া মাহফিল হবে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই কর্মসূচি ঘোষণা হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে সর্বশেষ ২০ দলীয় জোটের একবার ভার্চ্যুয়াল বৈঠক হয়। বিএনপি জোটের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী দল। তাদেরই জোট চাঙা করার ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা জোটগত রাজনীতি চালু রাখার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিয়েই অগ্রসর হতে হবে বলে মনে করি।
এবিষয়ে জোটের শরিক এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, জোটের এখন কোনো কার্যক্রম নেই। বিভিন্ন কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু সমস্যা রয়েছে। ফলে কোন জোটই সক্রিয় হচ্ছে না। এখানে অনেকগুলো দল আছে যাদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। কতদূর তাদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে, কতদূর সফলতা আসবে এটা বলা খুব কঠিন। আমি মনে করি, চালকের আসনে থাকা বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা সঠিক ভূমিকা পালন করলে সরকারের পতন যে কোনো সময় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এবিষয়ে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি ও মুখপাত্র সুব্রত চৌধুরী বলেন, বিএনপির সাথে জাতীয় ঐক্য কোন টানাপোড়ন নেই। জোটের অনেক দিন কোন কর্মসুচি ছিল না। গণফোরাম দলের ভেতরে কিছু সমস্যা ছিল। তা সমাধান করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি তাদের মতো করে কর্মসূচি পালন করছে। তারাও দল গোচ্ছাছে। এই মুহূতে জাতীয় এক্যফ্রন্ট কোন কর্মসূচি নেই। সামনে কর্মসূচি দেওয়া হবে। জোট গতিশীল করা হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আছে, থাকবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ২০ দলীয় জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে। জোটের মধ্যে কোন ধরনের অনিশ্চয়তা নেই। দুরত্বও সৃষ্টি হয়নি। বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করছে। সময়মতো মাঠের কর্মসূচি নিয়ে আমরা যৌথভাবে রাজপথে নামব। তাই বলে ২০ দলীয় জোট বা ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির টানাপড়েন চলছে, তা বলা যাবে না।