মো. শফিকুল ইসলাম: আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে (ইউপি) অংশ্রগ্রহন করবে না বিএনপি। দলের এমন ঘোষণার পর রাজনৈতিক বাঁকবদলের পথে নতুনভাবে হাঁটতে শুরু করেছে। দলের এমন সিদ্ধান্তে খুশি ও সাধুবাদ জানিয়েছে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তবে দলীয়ভাবে নির্বাচন না করলেও নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্রভাবে ঠিকই ভোটের মাঠে থাকবেন। ধানের শীষ প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী না হলেও স্থানীয় নেতাকর্মীরা ঠিকই অন্য প্রতীক নিয়ে ভোটে লড়বেন। কারণ নিজ এলাকায় অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে ভোট থাকতে চাইছেন। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। শেষ মুহূর্তে দলের হাইকমান্ড থেকেও এ বিষয়ে ‘গ্রীন সিগন্যাল’ পাওয়া যাবে বলেও আশা করছেন তৃণমূলের নেতারা।
তৃণমূলের নেতারা বলছেন, বারবার নির্বাচনে কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের নীরব সাক্ষী হওয়ার চেয়ে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়াই উত্তম। ২০০৮ সালের পর থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তারা। এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে সামান্যতম নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু ভোট পাননি তারা। প্রার্থী দিলে হামলা মামলার শিকার এবং ভোটের দিন কেন্দ্র দখল ও এজেন্টদের বের করে দেওয়াটা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একাকার হয়ে যায়। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ছাড়া শুধু শুধু নির্বাচনে গিয়ে লাভ নেই।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চান তারা। দলীয় প্রতীক ছাড়া কেউ নিজ যোগ্যতাবলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চাইলে তারা নমনীয় থাকবেন। একই সঙ্গে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল এবং বহিস্কারের ঝামেলাও এড়ানো যাবে। তবে সরকারি দলকে পুরো মাঠ ছেড়ে দেওয়া ভুল হবে বলেও মনে করছেন তারা।
দলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলছেন, দলের প্রায় ৩৫ লাখ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অজ¯্র মামলা রয়েছে। এছাড়া পৌরসভা নির্বাচনে গিয়েও মামলা হামলার শিকার হয়েছেন। এখন আবার নতুন করে এই নির্বাচনে গেলে হয়ত আরো অনেক মামলা হবে। এই সরকারের সংবিধানে সুষ্ঠু ভোট নেই সেটাও ৩০ ডিসেম্বরের রাতের ভোটে প্রমাণিত। তাই রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিও করেছেন তারা।
এদিকে, বিএনপি নেতাকর্মীদের ছোট একটি অংশ মনে করছেন, নির্বাচনে অংশ নিলে দলের নেতাকর্মীরা ‘চাঙ্গা’ হয়ে উঠতেন। নির্বাচন বর্জন করলে দল আরো ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হবে। সরকারি দল নির্বাচনে কারচুপি করলেও দেশি-বিদেশিরা তা দেখার সুযোগ পেতেন। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকা-না থাকার ব্যাপারে ‘কৌশলগত’ কোনো সিদ্ধান্ত আসবে বলেও আশা করছেন তারা।
জানা গেছে, গত রোববার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত জানায়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় প্রশ্ন তুলে নির্বাচন বর্জন করে দলটি। দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। এর আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করেননি। সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের মামলা হামলার মধ্যেও ১১টি আসনে জয়লাভ করে দলটি।
বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এটিএম আকরাম হোসেন তালিম বলেন, বিগত নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে আমরা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের চরিত্র দেখতে পেয়েছি। শুধু শুধু তাদের বৈধতা দিয়ে লাভ কী? তারচেয়ে দলকে শক্তিশালী করে আন্দোলনের জন্য তৈরি হওয়ার সিদ্ধান্তই যুগোপযোগী।
চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, দলের এই সিদ্ধান্ত খুবই সঠিক। এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়া উচিত। বর্তমানে নির্বাচনের নামে ভোট ডাকাতির খেলা হচ্ছে।
রাজশাহী বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও নাটোর জেলা শাখার সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এই প্রতিবেদককে বলেন, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলাম। কারণ এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। দল অনেক দিন পর সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া নির্বাচনে গিয়ে কেন আমরা বারবার ভুল করব?
এবিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু এই প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে তাতে অংশ নেওয়া বা না নেওয়া একই কথা। এভাবে ভোটে গিয়ে বারবার ভুল করতে চাই না। এছাড়া তৃণমুলের মতো বড় অংশকে মামলা ও হামলার হাত থেকে বাঁচানো যাবে।
এই সিদ্ধান্তে তৃণমূলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্থ হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনোভাবেই বিএনপি ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। বরং বিএনপি এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তৃণমূলের নেতাকর্মীও এখন অনেক বেশি সংগঠিত। তাই দলের সিদ্ধান্তই সঠিক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন, পৌরসভা ও সিটি নির্বাচনগুলোতে কি হয়েছে তা তো দেশের মানুষ দেখেছেন। এমনকি বিশ্ববাসীও দেখেছেন। এখন তো দেশে নির্বাচনই নেই। তাহলে আর নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করে লাভ কী। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না– এটা তো প্রমাণিত। তাই আমাদের এই সিদ্ধান্ত। সতন্ত্র হয়ে কেউ নির্বাচন করতে চাইলে তাকে বাধা দিবে না দল।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল। তাই কারচুপির নির্বাচনে ক্ষমতা গ্রহণ করা সরকার এবং বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের অধীনেও বিগত দিনে প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। কিন্তু এই সরকার গণতন্ত্র বিশ্বাস করে না। নির্বাচন কমিশন সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দলের স্থায়ী কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না।