জাতীয় পতাকা একটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতীক। একটি স্বাধীন জাতির পরিচয়ের চিহ্ন। ৫০ বছর আগের এই দিনটিতে বাংলার বুকে উড়েছিল আমাদের স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে থাকা এই মাতৃভূমির পতাকা। সবুজের মধ্যে লাল বৃত্তের সেই পতাকা বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতার নতুন সূর্যের প্রতীক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে নতুন এক দেশের যাত্রা শুরু হয়। তবে এর আগেই ২ মার্চ প্রথমবারের মতো পতাকা উত্তোলন হয়েছিল। সেই থেকে ২ মার্চ আমাদের জাতীয় পতাকা দিবস।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা হওয়ার পর সকাল থেকেই দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ঢাকার রাজপথে অবস্থান নেয়। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুম, নিগ্রহ, শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ জড়ো হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ ও জনতা পাকিস্তানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জানিয়ে দেয়, বাঙালিরা মাথা নত করবে না।
সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ওই সময়কার সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব। ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজের মতো ছাত্রনেতাদের উপস্থিতিতে আ স ম আবদুর রবের উত্তোলন করা সেই পতাকা স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ করে নতুন এক মাত্রা।
চাঁদ-তারা প্রতীকে তৈরি পাকিস্তানের পতাকা তখনকার বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল পরাধীনতার প্রতীক। সেই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ফুটিয়ে তুলতেই সবুজ জমিনে লাল বৃত্তের মাঝে এঁকে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের মানচিত্রের প্রতিরূপ। ২ মার্চের সেই পতাকাই জানান দেয়— স্বাধীনতা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের কোনো গতি নেই।
প্রকৃতপক্ষে সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। আর আমরা যাত্রা শুরু করি স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণ পথে। দীর্ঘ ৯ মাসের বহু ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর যুদ্ধের পুরোটা সময় এই পতাকাই প্রেরণা জুগিয়েছে কোটি বাঙালিকে।
তবে ১৯৭১ সালের ২ মার্চের পতাকাটি আজকের বাংলাদেশের পতাকার হুবহু প্রতিরূপ ছিল না। তখন সবুজ জমিনের পতাকায় লাল বৃত্তের মাঝখানে একটি হলুদ রঙের মানচিত্র ছিল। পরে পতাকা সহজ করতে মানচিত্রের প্রতীকটি বাদ দেওয়া হয়।
সেই পতাকার নকশাকার ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ। তবে শুরুতে কিন্তু পতাকা তৈরির উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজ ঘিরে। ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত সেই কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল।
এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। ছাত্রনেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১১৬ (বর্তমান ১১৭-১১৮) নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনে লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র-খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারি দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন।
এরপর ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হলের (বর্তমানে তিতুমীর হল) ৩১২ নম্বর কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকেন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ পরিশেষে তার নিপুণ হাতে মানচিত্রটি লাল বৃত্তের মাঝে আঁকেন। এভাবেই তৈরি হয় বাংলাদেশের প্রথম পতাকা।
এরপর ২ মার্চ ঢাবির কলাভবনে উত্তোলনের মাধ্যমে তৈরি হয় ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম নিজ হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে ধানমন্ডিতে তার নিজ বাসভবনে। সেদিনই বঙ্গবন্ধু প্রথম অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাশের নকশা করা পতাকার মাঝের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলেন পটুয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান পরিমার্জন করে আমাদের পতাকার বর্তমান রূপটি পরিস্ফূট করেন।
তখনই নির্ধারিত হয়— দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১০ অনুপাত ৬ মাপে গাঢ় সবুজ রঙের আয়তকার ক্ষেত্রের মাঝখানে হবে একটি লাল বৃত্ত। লাল বৃত্তটির ব্যাসার্ধ হবে পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ। পতাকার দৈর্ঘ্যের নয়-বিংশতিতম অংশ থেকে অঙ্কিত উলম্ব রেখা এবং পতাকার প্রস্থের মধ্যবর্তী বিন্দু থেকে অঙ্কিত আনুভূমিক রেখার পরস্পর ছেদ বিন্দুই হবে বৃত্তের কেন্দ্র। অর্থাৎ পতাকার দৈর্ঘ্যের ২০ ভাগের বাম দিকের ৯ ভাগের শেষ বিন্দুর ওপর অঙ্কিত লম্ব এবং প্রস্থের দিকে মাঝখান বরাবর অঙ্কিত সরলরেখার ছেদবিন্দু হলো বৃত্তের কেন্দ্র।