আগামী ২৬ মার্চ ৫০ বছরে পা রাখবে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বিশেষ এই দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর-মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই খসড়া তালিকা প্রকাশের কথা জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে দেশের অধিকাংশ উপজেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খসড়া তালিকা চলে এসেছে। তালিকা এসেছে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির কাছ থেকেও। বাকি যা আসেনি, সেসবের জন্য আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে খসড়া তালিকা প্রকাশের কথা জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করা হবে। তবে হয়তো কিছু বাদ থাকবে। সেগুলো তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে। বাদ পড়ার পর কেউ অভিযোগ দায়ের করেছে কিংবা আপিল করেছে— সেগুলো আপাতত বাদ থাকবে। তদন্ত নিষ্পত্তি হলে সেসব নাম তালিকায় যুক্ত করা হবে। তবে এই বাদ থাকাদের সংখ্যা সারাদেশে তিন থেকে চার হাজারের বেশি হবে না।
জানা যায়, যাচাই কার্যক্রম তদারকির জন্য একটি সেল গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) আট কর্মকর্তাকে আট বিভাগের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর বাইরে সারাদেশে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়েছে। এর আগে জামুকার সুপারিশ ছাড়া যাদের নাম বীর-মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বেসামরিক গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের মধ্য থেকে ৩৯ হাজার ৯৬১ জনের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। উপজেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাই শেষে এরইমধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৩৮৬ জনে।
এর আগে, গত বছরের ২ জুন নতুন করে এক হাজার ২৫৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এতে স্বীকৃতি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩ হাজার ৫৬ জনে। তবে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় এটাকে প্রকৃত সংখ্যা বলা যাচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, দেশের ১ লাখ ৭২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এবং ১১ হাজার শহিদ, যুদ্ধাহত ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতি মাসে ভাতা দিচ্ছে সরকার। একজন মুক্তিযোদ্ধা সব মিলিয়ে বছরে ভাতা পান ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। আগে ১ লাখ ৯২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে ভাতা পেতেন। কিন্তু বর্তমানে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) মাধ্যমে এই ভাতা বিতরণ করা হয় ১ লাখ ৭২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার মাঝে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে নামের বানানে মিল না থাকা, গেজেটের সঙ্গে অন্য কাগজপত্রের মিল না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে ভাতা সুবিধা থেকে বাদ পড়েছেন ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সফটওয়্যারেরর মাধ্যমে ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
আর মাত্র ক’দিন পরেই পূর্ণ হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর। দীর্ঘ এই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন মানদণ্ড বদলেছে, বদলানো হয়েছে সংজ্ঞাও। এ পর্যন্ত ছয় বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার।
১৯৭২ সালে জারি করা এক আদেশে বলা হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সংগঠিত দলের সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। সে হিসাবে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর সইযুক্ত সনদ যাদের কাছে ছিল, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
পরে মু্ক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন— এমন মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেওয়া শিল্পী-সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক এবং দেশ-বিদেশে বিভিন্নভাবে অবদান রাখা ব্যক্তিরাও। তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়সের সীমাও কয়েকবার নির্ধারণ করা হয়েছে। সবশেষ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম সাড়ে ১১ বছর নির্ধারণ করে সরকার। এই বয়স নিয়েও আছে নানান বিতর্ক।
এতদিনেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করতে না পারা ব্যর্থতা মেনে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষমতায় এসে এ মন্ত্রণালয়ে সঠিকভাবে কোনো কাগজপত্র পাইনি। দেখা গেছে কারও গেজেটে নাম আছে, কিন্তু তালিকায় নাম নেই, নথিতে নেই। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে যা তা অবস্থা করেছে। মন্ত্রণালয়ে জনবল কম ছিল। সব মিলিয়ে এসব গুছিয়ে আনতে সময় লেগেছে। এখন সবকিছু কম্পিউটারাইজড করা হচ্ছে। একটা শৃঙ্খলা চলে এসেছে। শিগগিরই অবস্থার উন্নতি হবে।