মো. শফিকুল ইসলাম: নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন, সরকারের পদত্যাগ এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন পুর্নগঠন এই ন্যূনতম দাবির ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য চায় বিএনপি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বলয়ের বাইরে থাকা বাম ও অন্যান্য দলগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে চাইছে দলটি। এমনকি সরকার বিরোধী মতবাদদেরও কাছে টানার চেষ্টা করছে তারা। একমঞ্চে না হলেও যার যার অবস্থান থেকেই যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তাবও আছে দলটির। কিন্তু বিএনপির দীর্ঘ ২১ বছরের জোটসঙ্গী জামায়াত কারণে দুই জোটের বাইরে থাকা দল ও জোটসমূহের যোগ দেওয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়ে ছিল। দেশের স্বার্থে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যর রাজনীতিতে জামায়াত ইসলামী কোন ফ্যাক্টর হবে না। এমনটি জানিয়ছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
অন্যদিকে বিএনপির জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, এখানে কে কোন রাজনৈতিক দল থেকে এসেছে বা কোন কোন দল থাকছে এটা কোনো ফ্যাক্টর নয়। আলোচনা মাধ্যমে জোট গঠন করা হবে। জোটের একটা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকবে। সাথে জোটের নৈতিকতা থাকতে দরকার। জোটের মধ্যে প্রত্যেক দল ও দলের নেতাদের কার কি ভূমিকা থাকবে তাও পরিষ্কার করা দরকার।
বিএনপি নেতারা বলছেন, দলীয় আদর্শ নয় বরং দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতাই হবে এই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি। তবে বামজোটের নেতারা বলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ও জামায়াত প্রশ্নে অবস্থান পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কোন ঐক্যে গঠন করা হবে না। জামায়াত সর্ম্পকে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। বিশে^র বিভিন্ন দেশে জোটগত আন্দোলনে সফলতা এসেছে। তাই সরকার পদত্যাগের বৃহত্তর আন্দোলনে যোগ দিবেন অনেক নেতাকর্মী বলে মনে করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৪টি। আর নিবন্ধনহীন দলের সংখ্যা আরো বেশি। তবে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বলয়ে বিভক্ত। এর বাইরে কয়েকটি দল বা জোট রয়েছে যাদের বেশ কিছু কর্মসূচির সঙ্গে মিল রয়েছে বিএনপির। অবশ্য ছোট-বড় দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আসার আহবান অনেক আগেই জানিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও। ইতিমধ্যে সরকার বিরোধী এসব দলগুলোর ‘অভিন্ন’ দাবিগুলো সমন্বয় করে একটি চূড়ান্ত প্রস্তাবনা তৈরি করেছে দলটি। ‘জাতীয় ঐক্যের সনদ’, ‘জাতীয় ঐক্যের রূপরেখা’, ‘জাতীয় ঐক্যের দাবি ও লক্ষ্য’ এবং ‘জাতীয় ঐক্য অর্জনের প্রস্তাবনা’ – এর মধ্যে একটি নাম চূড়ান্ত হবে। এছাড়া সরকার বিরোধী মতবাদ ও দলগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই মঞ্চ শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের পদত্যাগের কথা একই দাড়িয়ে বক্ততাও বলছেন।
বিএনপির নীতিনির্ধারক বলছেন, জাতীয় ঐক্য গড়ার ধরন হবে একটু আলাদা। নির্বাচনী জোটও হতে পারে। আবারা দলীয় ভাবে নির্বাচনের সিধান্তও হতে পালে। এই মুর্হুতে দেশে গণতন্ত্র, সংবিধান নেই। ভোট কারচুপি বা আগের রাতেই হচ্ছে তা এখন দেশের জনগণের কাছে পরিষ্কার। ভোটারা তাদের পছন্দ প্রার্থীকে ভোট দিতে পারছেন। কেন্দ্র যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ফলে এটি কোনো নির্বাচনই নয়। এটি এখন প্রমাণিত এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। এ অবস্থায় দেশের সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন ঘটাতে চায় বিএনপি।
বাম নেতারা বলছেন, রাজনৈতিক বাস্তবতায় আলোচনা যে কোন দলের সাথেই হতে পারে। তবে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের আগে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। জোট গঠন করলে দলের ভেতরে কার কি অবস্থা হবে তাও পরিষ্কার করতে হবে বিএনপিকে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান দিন পরিবর্তনকে বলেন, কর্তৃত্ববাদের অবসান ঘটাতে হবে কিন্তু কিভাবে। এসব চিন্তা ভাবনা নিয়ে যদি কোন পরিকল্পনা হয় তাহলে তো যেকোন দলের সঙ্গেই কথা বলা যায়। সরকারের পদত্যাগের জন্য জোটবদ্ধ আন্দোলনের দরকার।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বিএনপির সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে একই মঞ্চে বা একই প্লাটফর্মে দাঁড়ানোর এখন পর্যন্ত কোন পরিকল্পনা হয়নি। আলোচনা চলছে কিন্তু আমাদেরও বামজোট রয়েছে। সব দলের সাথেই আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা আগেই জাতীয় ঐক্য ডাক দিয়েছে। কারণ বর্তমানে দেশ গণতন্ত্র নেই, ভোটাধিকার নেই, মানুষের স্বাধীনতা নেই। এই স্বৈরাচার সরকারের পতনের জন্য জাতীয় ঐক্যর বিকল্প নেই। ব্যাপক জণগনের অংশগ্রহনে হবে এই জাতীয় ঐক্য। আমরা চাই সব রাজনৈতিক দলগুলোকে এক হয়ে সরকার পদত্যাগের আন্দোলন নামা উচিত। জাতীয় ঐক্য সব দলই থাকবে আশা করি।
এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আতাউল্লাহ আমিন বলেন, বিএনপি যদি জাতীয় ঐক্যর প্রস্তাব দেয় তাহলে দলীয় ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিএনপির ন্যূনতম দাবি সাথে একমত দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের। দেশের মানুষ গনতন্ত্র চায়, সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, স্বাধীনতা চায়। একটি সত্যিকারের জোট হলে এখানে জামায়াত কোন ফ্যাক্টর নয়। দেশের স¦ার্থে ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই এক হতেই পারে। অতীতে দেশের ইতিহাসে জামায়াতকে সাথে নিয়ে রাজনীতি করেছে অনেক দল। আমরা জনগণের সরকার চাই। তাই আগামী জোট হবে কি না দেখা যাবে।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতারুল ইসলাম বলেন, বিএনপি অতীতেও ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ছিল। বিএনপি তাদের অতীতের কর্মকান্ডের জন্য এখনোও ক্ষমা চায়নি। আর এখন আওয়ামী লীগ জঘন্য করছে। তারাও ভোটারবিহীন নির্বাচন করছে। তাদের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড করছে। দুই দলই প্রশাসন ব্যবহার করে নির্বাচন করেছে। তারা জনগণের অধিকার কখনো প্রতিষ্ঠান করেনি।
তিনি বলেন, অতীতে আওয়ামী লীগ বিএনপি ও জাতীয় পার্টি কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন করেনি। তবে তত্ববধায়ক সরকারের আমলে কিছুটা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল। বিএনপি আর আওয়ামী লীগের চরিত্র এক। আমরা জনগণের স্বার্থে আন্দোলন করি। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামব। দেশের জনগণের অধিকারের প্রতিষ্ঠা করব।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজাম্মান দুদু বলেন, দেশে গনতন্ত্র নাই। নূন্যতম ভোটাধিকার ও মানুষের কোন নিরাপত্তা নেই। সরকারের নামে বিভিন্ন সংবাদ বিশ্বের গণ্যমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। তাদের আমলে দুর্নীতি-অপকর্ম প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের অতীতে স্বাধীনতা ও গনততেন্ত্রর জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। তাই বর্তমান স্বৈরাচার সরকারের পরিবর্তনের জন্য ঐক্য দরকার। দেশের ভালো পরিবর্তনের জন্যই সবাই এক হবে আশা করি।
তিনি বলেন, বামজোট, হেফাজত ও জনগণ সবাইকে নিয়ে ঐক্য করতে চাই। এছাড়া সরকার বিরোধী যারা রয়েছে সবাই নিয়েই এই জাতীয় ঐক্য গঠন করা হবে। দুই মাথার চেয়ে কিন্তু একমাথা বড়। দ্বিতীয় মাথা যত ছোট হোক না কেন আপনার সঙ্গে একসাথে হওয়াটা বোনাস। দেশের জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে আমাদের সবাইকে এক হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, আমাদের সবারই গন্তব্যস্থল কিন্তু একটাই। সবাই সেই পথে চলছি, বিভিন্ন অবস্থান থেকে চলছি। আমরা সবাইকে নিয়ে আগাতে চাই। ঘরে আগুন লেগেছে, সেই আগুন নেভাতে হবে। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ডান-বাম, সামনে-পিছে কিছু নাই এটা সবার আন্দোলন সংগ্রাম। দেশ বাঁচানোর সংগ্রাম।
তিনি আরো বলেন, সরকার সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ। দুর্নীতি, অনিয়ম, গুম-খুন এসব সরকারের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হয়ে উঠেছে। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে যারাই প্রতিবাদ করছে তাদের নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে তারা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক দল হিসাবে আমরাও নীরব থাকতে পারি না। তাই জনগণের অধিকার আদায়ে আমরা তৎপর আছি। সব দলগুলোকে সাথে নিয়ে আগামী বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলব। এই সরকারের পতন হবে, দেশের মানুষও মুক্তি পাবে।