বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরে স্বাধীনতা— সবকিছুই বাঙালিকে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরেই কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম করেই সবকিছু অর্জন করতে হয়েছে। কেউ কোনোকিছু সেধে আমাদের দেয়নি— এ কথাটা মনে রাখতে হবে।
শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক-২০২১ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যুক্ত ছিলেন অনুষ্ঠানে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মন্ত্রিপরিষদের সিনিয়র সদস্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গুণীজনদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব বদরুল আরেফীন। অনুষ্ঠানে একুশে পদকপ্রাপ্তদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রান্তে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
ওসমানী মিলনায়তন প্রান্তেই জাতীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২১ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে একুশে পদক ২০২১ তুলে দেওয়া হয়। এসময় করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ওসমানী মিলনায়তনে সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারায় আফসোস করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর একটি বিজাতীয় ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। অথচ পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৬ ভাগেরও বেশি ছিল বাঙালি। তাই সেই চাপিয়ে দেওয়া ভাষা মানতে পারেনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা। এসময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রসমাজের প্রতিবাদ ও ১৯৪৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরুর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।‘কেউ সেধে কিছু দেয়নি, আন্দোলন-সংগ্রাম করেই অর্জন করেছি’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। কারণ যারা আমাদের ভাষা ওপর আঘাত করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই তিনি প্রতিবাদ শুরু করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তমুদ্দিন মজলিসসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের সবাইকে নিয়ে তিনি প্রথম একটি সভা করেন। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হবে। সেই সভা থেকেই সিদ্ধান্ত হয়, একটি তারিখ ঘোষণা করে আন্দোলন শুরু হবে।
ভাষা আন্দোলন ও এই আন্দোলনে জাতির পিতার ভূমিকার কথা জানার জন্য পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের প্রতিবেদনগুলো নিয়ে প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ের খণ্ডগুলো পড়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী ভাষা শহিদ রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ সবার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘এই রক্ত দিয়েই রক্তের অক্ষরে নিজের মাতৃভাষায় আমরা কথা বলতে চাই। মা’কে মা বলে ডাকতে চাই। সেই কথাটাই তারা লিখে গিয়েছেন। তারপরও কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়নি। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনা করে সেখানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।
বায়ান্নতে ভাষার জন্য আত্মাহুতি দেওয়া ভাষা শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে সামরিক সরকার আসার পর তা অগ্রসর হতে পারেনি। অর্থাৎ প্রতি পদে পদেই বাধা এসেছে, প্রতিবন্ধকতা এসেছে। তবে সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেই ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আরও অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত একাত্তরে আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরেই কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম করে সবকিছু অর্জন করতে হয়েছে। কেউ আমাদের সেধে কিছু দেয়নি— এ কথাটা মনে রাখতে হবে। একটি জাতিকে যদি ক্ষতিগ্রস্ত করতে হয় বা তার মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হয়, তাহলে তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে হয়। পাকিস্তানিরা সেই চেষ্টাই করেছিল।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বায়ান্নর আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা এই কথাগুলোর মধ্যে পাবেন রাজনৈতিক অধিকার। এটা আমাদের স্বাধীনতাকেই বোঝায়। স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের মৌলিক যে চাহিদাগুলো, সেগুলো পূরণের কথাই তিনি বলেছিলেন। কাজেই তিনি ভাষা আন্দোলন থেকেই কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যান। সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মা’কে মা ডাকার অধিকার পাই, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৯ সালে এই দিনটির আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির গৌরবময় অধ্যায়ের কথাও স্মরণ করেন।
একুশের চেতনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের ভাষা। এই বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে। সম্মানের সঙ্গে চলবে। কারও কাছে হাত পেতে নয়, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলব।