এসএম শামসুজ্জোহা: উচ্চ আদালতে সক্রিয় জামিন জালিয়াত চক্র। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ও কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে আসামিদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে টাকা হাতাতে উচ্চ আদালতে তথ্য জালিয়াতি করছে। সিন্ডিকেট তৈরি করে জামিন জালিয়াতি থেকে শুরু করে আদালত প্রাঙ্গণে নানা অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। এর সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কেউ কেউ জড়িত। তারা মামলার প্রকৃত তথ্য গোপন রেখে, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জামিন নিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করছে প্রতারক চক্রটি। ফলে খুন, ডাকাতি, ধর্ষন ও মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত অনেক ভয়ঙ্কর আসামি ভূয়া জামিননামার মাধ্যমে জামিন নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। এ ধরনের ঘটনায় অনেক সময় বিচারপ্রার্থী ফেঁসে গেলেও পার পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা।
সম্প্রতি জামিন জালিয়াতের এমন কিছু ঘটনা নজরে আসে হাইকোর্টের। ২০১৬ সালে জালিয়াতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। আরো তিনজন স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১৭ সালে প্রথম অন্তত আটজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ পর্যন্ত নিম্ন আদালতের ১৬৮ কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের কাছে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, গত তিন মাসে অন্তত ৫টি জামিন জালিয়াতির ঘটনা হাইকোর্টে ধরা পড়েছে। শুধু হত্যা মামলাই নয়, জাল নথি সৃজনের পাশাপাশি তথ্য গোপন ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অস্ত্র, ধর্ষণ মাদক মামলাসহ বিভিন্ন গুরুতর মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়া হচ্ছে। জামিন নেয়ার ক্ষেত্রে ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট, জব্দ তালিকা দাখিল করা হচ্ছে। অভিযোগের গুরুত্ব কমিয়ে তৈরি করা কাগজপত্র দেখিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করে পক্ষে নেওয়া হচ্ছে। ফৌজদারি বিবিধ শাখায় এসব ঘটনা বেশি ঘটছে। জামিন আদেশের কপি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা ফৌজদারি শাখার জমাদার মঞ্জু রানী কৈরীকে বরখাস্ত করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এরপর কিছুদিন জামিন জালিয়াতির ঘটনা থেমে ছিল।
সূত্র জানায়, হাইকোর্টের নির্দেশে নথি ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টির মতো মামলা দায়ের করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এর মধ্যে ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে ২৯টি, রিট শাখা থেকে ৯টি, ফৌজদারি আপিল শাখা থেকে ২টি এবং অন্যান্য শাখা থেকে ১০টি। এসব মামলা তদন্ত ও বিচারাধীন রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাইকোর্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, জামিন জালিয়াতি রোধে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, জামিন জালিয়াতির ঘটনায় সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর তদন্ত চলছে। জালিয়াতিতে কারা জড়িত তা পুলিশের তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন শহিদুল্লাহ খান নামের এক ব্যক্তি। এসংক্রান্ত মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন চেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। যান উচ্চ আদালতে। সেখানে দায়েরকৃত জামিন আবেদনে বদলে দেন মামলার মূল এজাহার ও চার্জশিট। ঐ এজাহারে ২ হাজার পিস ইয়াবার স্থলে মাত্র ২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার দেখানো হয়। মেলে জামিনও। উচ্চ আদালতের জামিননামা দাখিল করলে জালিয়াতির বিষয়টি নজরে আসে গোপালগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের। তিনি জালিয়াতির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন হাইকোর্টে পাঠান। এরপর জামিনদানকারী হাইকোর্টের বেঞ্চের নজরে আনা হলে স্থগিত করা হয় জামিন। জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তলব করা হয় ঐ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের নকল শাখার তিন কর্মচারীকে। আগামী সপ্তাহে হাইকোর্টে হাজির হয়ে তাদের লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়েছে।
জালিয়াতি করে জামিন হাসিলের কয়েকটি মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখতে পাওয়া যায় যে, বেশির ভাগ জামিন জালিয়াতির ক্ষেত্রেই মামলার মূল এজাহার, পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন, জব্দ তালিকা এমনকি অধস্তন আদালতের রায় ও আদেশ পালটে দেওয়া হয়েছে। এ কাজে জড়িত চক্রে সবার আগেই উঠে আসে মামলার তদবিরকারকের নাম। রয়েছে কিছু অসাধু আইনজীবী ও আইনজীবীর সহকারীর নাম। নতুন করে উঠে এসেছে দুই কারারক্ষীর নাম। রয়েছে কোর্টের বিভিন্ন শাখার কিছু অসৎ কর্মচারীরা।
সম্প্রতি দুটি জামিন জালিয়াতির মামলা পরিচালনায় ঢাকার এক আইনজীবীর নাম আসায় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ বলেন, বলুন তো- এ ধরনের ঘটনায় আইনজীবী হিসেবে কেন আপনার নাম বারবার আসছে? তখন ঐ আইনজীবী দাবি করেন, তিনি জালিয়াতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। পরে হাইকোর্ট তদন্তের নির্দেশ দিয়ে বলেছে, জালিয়াতির ঘটনায় আইনজীবী জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ধর্ষণ মামলার রায় পালটে দিয়ে জামিন আবেদনের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষন মামলার আসামি কবির বিশ্বাসের যাবজ্জীবন সাজা হয়। কিন্তু তিনি দুই কারারক্ষী ও মামলার তদবিরকারকের সহযোগিতায় রায়সহ মামলার সব মূল নথি পালটে যাবজ্জীবন সাজার স্থলে সাত বছর দেখিয়ে জামিন চান। জালিয়াতির বিষয়টি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী হাইকোর্টের নজরে আনলে দুই কারারক্ষীসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দেয় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
এই জালিয়াতি উদ্ঘাটনের রেশ মিলিয়ে না যেতেই অস্ত্র মামলার এজাহার পরিবর্তন করে জামিন হাসিল করেন ১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আব্দুস সাত্তার। জালিয়াতির বিষয়টি নজরে আসায় জামিনদানকারী বেঞ্চ আসামির জামিন বাতিলের আদেশ দেয়।
গত বছরের ২ ডিসেম্বর মোহাম্মদ রশিদ। বয়স ৩৭। চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৪টি স্বর্ণের বার ও ৭৭টি স্বর্ণের চেনসহ আটক হয়েছিলেন। একাধিকবার জামিন আবেদন করেও বিচারিক আদালতে তার জামিন হয়নি। এর পরেও তিনি হাইকোর্টের জাল জামিন আদেশ দিয়েই কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন। কারাগার থেকে ছাড়া পেতে রশিদের পক্ষে যে জামিন আদেশ দাখিল করা হয়েছে এতে দেখানো হয়, গত ২১ জুন বিচারপতি মোঃ রেজাউল হক ও বিচারপতি মোঃ খসরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার কোন জামিন আবেদনই জমা পড়েনি উচ্চ আদালতে। রশিদের জাল জামিন আদেশে জামিন আবেদনের যে নম্বর দেয়া হয়েছে (২০৪৪৪/২০১৫) সেটিও অন্য একটি মামলার।
গত বছরের ২০ মার্চ ৩০টি স্বর্ণের বারসহ আটক হন সুখলাল দাস। বয়স ৩০ বছর। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সুইপার। কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিচারিক আদালতে তারও জামিন হয়নি। তিনিও রশিদের মতোই ভুয়া জামিন আদেশ দিয়েই কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন। কারাগার থেকে ছাড়া পেতে সুখলাল যে জামিন আদেশ দাখিল করেছেন, এতে দেখা যায়, রশিদ হাইকোর্টের যে কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন তিনিও একই কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন গত ২৮ জুন। তার পক্ষেও হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় কোন জামিন আবেদন পাওয়া যায়নি। সুখলালের জাল জামিন আদেশে আবেদনের যে নম্বর দেয়া হয়েছে (২১৮৮৭/২০১৫) সেটিও ভিন্ন একটি মামলার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টে কোন আসামির জামিন হলে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে টেলিফোনে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোন আসামি ছাড়া পায় না। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মোহাম্মদ রশিদ ও সুখলাল দাসের জামিন জালিয়াতির ঘটনায় হাইকোর্টের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত কি-না? রশিদ ও সুখলালের জামিন জালিয়াতির নথিপত্র বর্তমানে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল মঙ্গলবার বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীর পক্ষে জাল নথি যাচাই করা সম্ভব নয়। এ কারণে অনেক সময় আইনজীবীরাও এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন। মামলা এফিডেভিট ও ফাইলিংয়ের ক্ষেত্রে যদি তদবিরকারকের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়। তাহলে জালজালিয়াতি কমে যাবে। কারণ যারা এই জালিয়াতি করেন, তারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এটা করে থাকেন। বারের পক্ষ থেকে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। জালিয়াতির ঘটনায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
এসব বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি দিন পরিবর্তনকে বলেন, জামিন জালিয়াতির বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আমরা এসব জামিন জালিয়াতি রোধ করতে কাজ করছি। ভবিষ্যতে টেলিফোনে কনফার্মেশনের পরিবর্তে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এ কাজটি করার বিষয়ে কাজ চলছে।
হাইকোর্টে তথ্য গোপন বন্ধের স্থায়ী কোন সমাধান আছে কিনা জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন মঙ্গলবার বলেন, আদালতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করা সম্ভব না হলে এ অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে না। আমরা এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করবো। মামলার এফিডেভিট পদ্ধতি বদলাতে হবে। আসামিদের নাম দিয়েই যেন মামলা এন্ট্রি করা হয়, সে বিষয়ে জোর দেবো।